একসময় রক্তদান শিবিরের সঙ্গে ‘স্বেচ্ছা’ শব্দটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু বর্তমান সময়ে পাইয়ে দেওয়ার মানসিকতা থাবা বসিয়েছে এই মহতী কাজেও। কোথাও মোবাইল তো কোথাও রক্তের বিনিময়ে দাতাদের দেওয়া হচ্ছে এক কেজি ওজনের ইলিশ। সঙ্গে গুঁড়ো মশলা এবং সর্ষের তেলের প্যাকেট! কোথাও আবার উপঢৌকনের তালিকায় রয়েছে ওয়াটার ফিল্টার, প্রেশার কুকার, রান্নার বাসন, ট্রলি ব্যাগ, সোনার দুল ও বড় দুর্গাপূজার ভি.আই.পি পাস। শিবিরে শিবিরে রক্তদাতা জোটাতে পাল্টা ‘উপহার’।
এই বিষয়ে নানান ধারাবাহিক অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৫ মে ২০১৮ তারিখে স্বাস্থ্য ভবন থেকে রাজ্যের যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (রক্তসুরক্ষা) স্বাক্ষরিত একটি সরকারি নির্দেশনামা ( WBSAPC/2B-20-2017/182 ) জারি করা হয়েছিল রক্তদান শিবিরে আর উপহার দেওয়া যাবে না রক্তদাতাদের - এই মর্মে । রক্তসুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘রাজ্য এইডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতি’র জারি করা এই অর্ডারে রাজ্যের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ককে রীতিমতো নির্দেশনামা পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে রক্তদানের ক্ষেত্রে উপহার দেওয়া নিষিদ্ধই । এবং রাজ্যের সব ব্লাড ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘উপহার নেই’ অঙ্গীকারে শিবির উদ্যোক্তাদের থেকে মুচলেকা নিয়ে তবেই ওই শিবিরে রক্ত সংগ্রহে যেতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা। ন্যাকো এবং জাতীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের নিয়মাবলি ও ড্রাগ ও কসমেটিক্স রুলস ১৯৪৫ (122-EA,Part –XB) উদ্ধৃত করে নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, রক্তদান শিবিরে রক্তদানের বিনিময়ে দাতাকে যে টাকাপয়সা কিংবা অন্য কোনও ধরনের উপহার (স্মারক নয়) দেওয়া হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করতে হবে রক্ত সংগ্রহকারী ব্লাড ব্যাঙ্ককেই । দীর্ঘ দিন ধরে উপহারের বিরোধিতা করে আসা রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মী-উদ্যোক্তারা স্বাস্থ্য দপ্তরের এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু আক্ষেপের সাথে বলতে হয় পরস্থিতি বদলায়নি । অনেক শিবির উদ্যোক্তাই রক্তদাতা টানতে এখনো দামী উপহারের ব্যবস্থা রাখছে । এই সব ঘটনা স্বেচ্ছা রক্তদান আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে ।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম মারফত প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে গত ১লা নভেম্বর শুক্রবার সকাল থেকে উত্তর কলকাতার কলেজ স্কোয়ারের কাছে ‘মির্জাপুর বান্ধব সম্মিলনী’র উদ্যোগে একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়।সেখানে স্লোগান ছিল, প্রলোভন নয় - স্বেচ্ছায় হোক রক্তদান। কিন্তু, ঐ শিবিরে ৪৯ জন রক্তদাতাকে দেওয়া হয়েছে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ও ইন্ডাকশন ওভেন । গোটা ঘটনায় ঢি ঢি পড়ে গিয়েছে রাজ্যজুড়ে।উপরন্তু আমরা অবাক হয়েছি এটা দেখে বা জেনে যে ‘মির্জাপুর বান্ধব সম্মিলনী’র সম্পাদক সঞ্জয় নন্দী রক্তের বিনিময়ে উপহার দেওয়ার বিষয়টিকে ‘গর্বের কাজ’ বলেই মনে করছেন, তাঁর কথায়, “বুকের পাটা আছে, তাই প্রকাশ্যে উপহার দিয়েছি। আগে যত বার এমন শিবিরের আয়োজন করেছি, রক্তদাতাদের উপহার দিয়েছি। পরের বছরও দেব ।” এখানেই থামছেন না তিনি । বলছেন, ‘‘অনেক বড় বড় নেতার রক্তদান শিবিরেও উপহার দেওয়া হয় । গত চার বছর ধরে রক্তদান শিবির করছি। প্রথম বছর পাখা, তার পর রেনকোট, মোবাইল, মিক্সচার মেশিন সব দিয়েছি। এ বার এক কেজি ইলিশ আর ইনডাকশন দিলাম। পরের বছর এর থেকেও ভাল কিছু দেব।”। এই ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে । আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি ও নিন্দা করছি । সরকারি নির্দেশনামা ভঙ্গকারী এই ঘটনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবী জানাচ্ছি। যদি প্রসাশনের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে অসুবিধা থাকে তাহলে আমরা ন্যায়ালয়ের দ্বারস্থ হব । পাশাপাশি মানিকতলা সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের মতো এশিয়ার প্রাচীনতম এবং সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক যে রক্তদান শিবিরের দায়িত্বে, সেখানে রক্তের বিনিময়ে দাতাদের ইলিশ মাছ আর ইন্ডাকশন কুকার উপহার দেওয়া হচ্ছে দেখেও ঐ শিবিরের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ও কর্মীবন্ধুরা তাৎক্ষণিক শিবির বন্ধ করে ব্যবস্থা নিলেন না কেন ? তাও সমানভাবে দেখা দরকার।
দীর্ঘদিন প্রচার চালিয়ে মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা গড়ে তোলা হয়েছিল । কিন্তু রক্তদানে এই ‘বিনিময় প্রথা’ তার মূলে আঘাত করছে। প্রথমত, ছোট ক্লাব বা সংগঠন আর্থিকভাবে সমর্থ না হওয়ায় এই ধরনের কাজে যুক্ত থাকায় উৎসাহ হারাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, উপহারের টানে অনেক রক্তদাতা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছেন। ফলে প্রচুর পরিমাণ রক্ত নষ্ট হচ্ছে ।
উপহারের বিনিময়ে রক্তদানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে মানুষকে সচেতন করে আসা রক্তদান আন্দোলন সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মীদের নিম্নলিখিত দাবিগুলি হলো –
·কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কিছু স্বেচ্ছা রক্তদানের শিবিরে রক্তদাতাদের দামী উপহার ও উপঢৌকন প্রদান করে রক্তদান আন্দোলনকে কলুষিত করার সাথে যুক্ত এবং সরকারি নির্দেশনামা ভঙ্গকারী অপ্রাধীদের শাস্তি চাই ।
রক্তদাতাদের উপহার ও উপঢৌকন প্রদান রোধে কঠোর সরকারী আইনী পদক্ষেপ চাই ।