দেশজুড়ে বিজেপি–আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি–রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস–বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ  চতুর্থ কিস্তি।
প্রকাশিত অংশের পর …
‘ সাহিত্য সম্রাট ‘ , মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাঙালিত্ব এবং ভাষাপ্রীতি নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই । কিন্ত ধর্ম তথা ব্রাম্ভণ বর্ণবাদী ভাবনা তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছে । আসলে সময় ও শ্রেণির প্রভাবকে  আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে তিনি এই ‘ ভাবানার ‘ প্রব্ক্তা ‘ হয়ে উঠেছেন । বাঙ্গালার  কৃষকের দুর্দশায় , অভাবগ্রস্থতায় চিন্তিত বঙ্কিম শেষ পর্যন্ত চিরদুঃখী কৃষক পরাণ মন্ডল ও হাসিম শেখকে একত্রে পাশে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারলেন না । প্রথম পর্বে ‘ সাম্য’-এ আগ্রহী মানুষটি শেষ বিচারে ‘ ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী ‘ হয়ে উঠেছেন । ‘ বর্ণবাদিতার প্রশয় ও প্রকাশ ‘ তাঁর শেষ দিককার রচনায় নিয়তি হয়ে হাজির হয়েছে।  ‘ আনন্দমঠ’ উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে সেই নিয়তিরই বহিঃপ্রকাশ এইভাবে , এই ভাষায় – ‘‘ সকলে বলিল , ‘ মুসলমান পরাভূত হইয়াছে ,  দেশ আবার হিন্দুর হইয়াছে । সকলে একবার মুক্তকন্ঠে হরি হরি বল “। [ —] ‘‘ গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায় । কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল । অনেক মুসলমান দাঁড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল । জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে  মুই হেঁদু ” ।
কি বলবেন ? দাঙ্গার ছবি ? দাঙ্গার পর দাঙ্গার যে ইতিবৃত্ত সমগ্র দেশজুড়ে আজও ঘটে চলেছে তারই কি জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িকতার অনির্বচনীয় ভাষ্য ? রণধ্বনি ?
শুধু কি তাই ? ভাষা থেকে বর্ণ অর্থাৎ রক্তের গরিমা , শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় উদ্ঘাটনেও তিনি অধিকতর প্রয়াসী হয়েছেন । ‘ বাঙ্গালীর উৎপত্তি’র পর ‘ধর্মতত্ত্ব’-এর স্বরূপ নির্ণয়ে তিনি লিখেছেন :
’ যে রক্তের তেজে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি সকল শ্রেষ্ঠ হইয়াছেন , বাঙ্গালীর শরীরেও সেই রক্ত বহিতেছে ।’ জাতির এই চিহ্নিতকরণে মূল সমস্যাটা হলো , ইংরেজ জাতির একত্বের পরিচয় ভাষার মধ্যেই প্রোথিত , রক্তে নয় । এই তত্ত্বেরই  এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্কর রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে । যার বিশ্বরূপ বিশ্বযুদ্ধে । মানবতার অশেষ দূর্গতি , অনিঃশেষ লাঞ্ছনায় সলিল সমাধিতে।
স্বভাবতই ‘ সাম্য ‘ নয় , ‘ ভারত-কলঙ্ক ‘-এর পথ বেয়েই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সহায়ক হয়ে উঠেছেন । না – হলে কখনোই তিনি লিখতে পারতেন না –
‘ আমি হিন্দু , তুমি হিন্দু, রাম হিন্দু , যদু হিন্দু , আরও লক্ষ লক্ষ হিন্দু আছে ।  এই লক্ষ লক্ষ হিন্দুমাত্রেরই যাহাতে মঙ্গল , তাহাতেই আমার মঙ্গল । যাহাতে তাহাদের মঙ্গল নাই , আমারও তাহাতে মঙ্গল নাই । অতএব সকল হিন্দুর যাহাতে মঙ্গল হয় তাহাই আমার কর্তব্য ।’
জাতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সোচ্চার , অগ্রণী ‘ শিক্ষিত শ্রেষ্ঠ ‘ শিল্পী মানুষটি এখানেই থেমে থাকলেন না। ‘ ভারত কলঙ্ক ‘-এর অপর ভাগে যা লিখলেন তাতে
‘ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিচ্ছরণ ‘ দ্যুতি পরবর্তীকালে হিন্দু মহাসভা , রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ , জনসঙ্ঘ কিংবা আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক মতাদর্শগত ভিত্তিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে । বঙ্কিমের এই ভাবনায় , মতাদর্শে- ‘ হিন্দু জাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে । তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে । অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল । যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ,সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাতে না হয় আমরা তাহাই করিব ।’
আবার এই ভাবনায় , অবস্থানগত নিরিখ ও ভাষার প্রশ্নে বাংলার মানুষ বাঙালি হিসাবে অবিভাজ্য হলেও ধর্ম ও বর্ণের প্রশ্নে বিভাজ্য । এই ধারারই এক অনিবার্য রূপ দ্বিজাতিতত্ত্বে ; ফলশ্রুতিতে দাঙ্গা , দেশভাগ , ক্ষমতার হস্তান্তর !


Find out more: