দেশজুড়ে বিজেপি–আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি–রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস–বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার ।
ধর্মকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নির্বাচন করে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রী অরবিন্দ ঘোষ এক উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিত্ব । রাজনৈতিক ভাবনা ও কার্যক্রমে চরমপন্থায় বিশ্বাসী , আপোষহীন মানুষটি ‘ কারাগার পর্ব’ –অন্তে শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন ‘ সর্বাত্মকরূপে আধ্যাত্মিক ‘ । যাঁর বিশ্বাসে, ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রকেও হতে হবে ভারতীয় , যেখানে ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান হয়নি । তারই বহিঃপ্রকাশ কারামুক্তি জনিত কলকাতায় প্রদত্ত এক সম্বধর্নায় সভায়–
‘ আমি তো আগেই বলেছিলাম যে এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয় , বলেছিলাম যে জাতীয়তাবাদ জিনিসটা রাজনীতি নয় , এ হচ্ছে একটি ধর্ম , একটি জীবন দর্শন , একটি বিশ্বাস । [ —-] আমি বলি যে আমাদের জন্য সনাতন ধর্মই হচ্ছে জাতীয়তাবাদ ।’
অবশ্য , বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ আনন্দমঠ ’-এর সন্ন্যাসীদের দৃষ্টান্ত যোগ্য প্রেরণা শুধু অরবিন্দের মধ্যেই নয় , সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনকেও গ্রাস করেছিল ।তারই পরিচয় বিধৃত হয়েছে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আত্মজীবনী ‘‘ ভারত স্বাধীন হল “-এর পৃষ্ঠায় । তাঁর স্মরণে বিপ্লবীরা সকলেই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক । এবং তিনি টের পেয়েছেন সবকটি দলই সক্রিয়ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী ।
স্বদেশের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর মেধাবী , কর্মকুশল ‘ মারাঠী বিপ্লবী ‘ বিনায়ক দামোদর সাভারকর জীবনের প্রথম পর্বে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের ভাবনা ব্যক্ত করলেও আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে ‘ ক্ষমা প্রার্থনা’র মাধ্যমে মুক্তি লাভের পর হিন্দু মহাসভার রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে জীবনের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন । ১৯৩৭-১৯৪২ পর্যন্ত হিন্দু মহাসভার প্রতিটি অধিবেশনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করা মানুষটির মনন চিন্তনে সর্বক্ষণ বিরাজ করেছে হিন্দুজাতি গঠন ও স্বাধীন ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা স্বপ্ন । ‘ মুসলিম তোষণে’র তত্ত্বে শুধু ইংরেজ সরকারই নয় , স্বয়ং জাতির পিতা মহাত্মাও তাঁর রোষ থেকে রেহাই পাননি । এই সাভারকারেরই তরুণ অনুগামীদের অন্যতম ছিলেন নাথুরাম গডসে । যাঁর গুলিতে বিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন জাতির পিতা ।
প্রসঙ্গত আমাদের মনে রাখতে হবে , মারাঠী বিপ্লবীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে হিন্দু প্রাধান্য ও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা । স্বাভাবিকভাবে ভারত ভাগের দাবিতে হিন্দু মহাসভা সোচ্চার হবে , এতে আশ্চর্যের কিছু নেই । মুসলিম লিগ কর্তৃক রাজনৈতিকভাবে ১৯৪০ সালে ‘ লাহোর প্রস্তাব’ পেশের অন্তত তিন বছর পূর্বে ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভা আহুত আহমেদাবাদের অধিবেশনে সভাপতি-রূপে সভারকার ঘোষণা করেন যে , ভারত একটি সুসংহত জাতিতে পরিণত হয়েছে বলে যারা মনে করে তার নিতান্তই ভ্রান্ত, কেননা ভারতে দুটি প্রধান জাতি বাস করে যাদের একটি হিন্দু , অপরটি মুসলমান । মারাঠী বিপ্লবীদের এই প্রত্যয় ঋদ্ধ ধারণা ও বিশ্বাসের মূলে ছিল দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ । আর্য-মারাঠীরা হিন্দু সম্প্রদায়কে বিশুদ্ধতায় ফেরানোর লক্ষ্যে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ রোধের পাশাপাশি প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে প্রত্যাবর্তনের নিমিত্তে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন ।
বাল গঙ্গাধর তিলকই প্রথম ব্যক্তি যিনি হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সংগঠিত রূপদান করেন । তিলকের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হলো ‘ গোরক্ষা সমিতি ‘( ১৮৯৩) , ‘ গণপতি উৎসব ‘( ১৮৯৪) ও ‘ শিবাজি উৎসব ‘ ( ১৮৯৬ )। অবশ্য জীবনের শেষপর্বে গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলনকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন । কিন্ত তাঁর অনুসারী সাভারকার -এর মুসলিম বিদ্বেষ ছিল খুবই স্পষ্ট । হিন্দু পুনরুত্থানবাদে বিশ্বাসী মানুষটি মুসলিম প্রশ্নে ছিলেন ভীষণভাবে আপোষহীন। গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না । রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার বিষয়ে তিনি ছিলেন এক আপোষহীন সংগ্রামী যোদ্ধা । তাঁর রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তথাকথিত ‘ হিন্দুত্ব ‘। আবার , এই ‘ হিন্দুত্ব’ বিষয়টি ধর্মীয় নয় , রাজনৈতিকও বটে । রঞ্জন গুপ্ত তাঁর ‘ বীর সাভারকার : ইতিহাসের আলোয় ‘ গ্রন্থে বিষয়টির অনুপুঙ্খ উন্মোচন করেছেন । যে উন্মোচনে সাভারকারের কাছে ‘ হিন্দুত্ব ‘ বিষয়টি পরিচয়জ্ঞাপক না থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছিল গুণবাচক।