প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার বেশীরভাগ মানুষই বিশ্বাস করতেন শাক্ত ধর্ম মতে। বড় বড় জমিদার থেকে শুরু করে ডাকাতরা—দেবীর কৃপা ও আশীর্বাদ পাবার জন্য সবাই ঘটা করে আয়োজন করতেন কালী পুজোর। এখনও বাংলায় সর্বাধিক জনপ্রিয় ও প্রচলিত পুজো হল কালী পুজো।
আমরা বাঙালীরা বিশ্বাস করি যে কালী ঠাকুর কখনও তাঁর ভক্তদের খালি হাতে ফেরান না। আর তাই বোধহয় সারা রাজ্য জুড়েই অসংখ্য কালী মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে, আর তাদের ঘিরে রয়েছে নানা মিথ, পুরাকাহিনী ও লোকবিশ্বাস। আজ জেনে নিন জাগ্রত ছয়টি কালী মন্দিরের কথা—যেখানে লোকে বিশ্বাস করে আপনি যদি দেবীর আশীর্বাদ চাইতে যান, তাহলে দেবী আপনাকে খালি হাতে ফেরাবেন না। সবসময়ই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।
কালীঘাট- কালীঘাটের কালী মন্দিরটি বোধহয় পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দিরের মধ্যে একটি। মন্দিরটিকে এখন যে অবস্থায় দেখছেন, সেটির বয়স মাত্র দু’শ বছর হলেও কালীঘাটের মন্দিরের ইতিহাস এর থেকেও বহু প্রাচীন। মনসামঙ্গলেও এর নাম পাওয়া যায়। বুঝতেই পারছেন কালীঘাটের প্রাচীনত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা। সেই ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকেই বাংলার মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে আসতেন কালীঘাটে দেবীর আশীর্বাদ চাইতে। দেবী অবশ্য আশীর্বাদ দিতেনও। কালীঘাট অঞ্চলে যান, শুনতে পাবেন মন্দিরকে ঘিরে হরেক গল্পকথা।
মূল মন্দিরটি ৬ টি খন্ডে বিভক্ত নাটমন্দির, ষষ্ঠী তলা, হাড়িকাঠতলা, রাধাকৃষ্ণ মন্দির, চোর বাংলা, কুন্ড পুকুর। বর্তমানে যে মূর্তিটি পূজা করা হয় সেটি কষ্টি পাথরের তৈরি। এছাড়াও সোনা এবং রুপার অলংকার ধাতু নিয়ে এই মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। এই মূর্তির জিভটি পাল্টানো হয় জীভটি ২কিলোগ্রাম রুপো এবং ৫১৬গ্রাম সোনা দিয়ে তৈরি করা। এছাড়াও দেবীর খড়গটি ২কেজি সোনা দিয়ে তৈরি। লোক মুখে শোনা যায় পূর্বে এই মন্দিরে নিয়মিত ছাগ বলি দেওয়া হতো। বর্তমানে বিশেষ বিশেষ দিনে এই ছাগ বলি দেওয়া হয়। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে দেবীকে স্নান করানো হয় যা “স্নানযাত্রা” নামে পরিচিত। ভক্তদের কাছে এই মন্দিরটি অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির নামে পরিচিত।
কীর্তিশ্বরী মন্দির, মুর্শিদাবাদ- ৫১ পীঠের অন্যতম মন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দির হল একটি। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটি এই জেলার অন্যতম প্রাচীন কালী মন্দির। এই মন্দিরের পুরাতন কাঠামো বর্তমানে নষ্ট হয়ে গেলেও গেলেও নতুন আঙ্গিকে এই মন্দির গড়ে তোলেন ঊনিশ শতকে রাজা বা জমিদার দর্প নারায়ণ। অত্যন্ত জাগ্রত মন্দির বলে প্রসিদ্ধ সারা বাংলা জুড়ে এই মন্দির।
সারা মুর্শিদাবাদ তথা পশ্চিমবঙ্গ এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে নানা ধর্মপ্রাণ ধর্মপ্রাণ থেকে নানা ধর্মপ্রাণ থেকে নানা ধর্মপ্রাণ মায়ের উপাসকরা এই মন্দিরে ভক্তিভরে পূজা দিয়ে যান দিয়ে যান এবং তাদের মনষ্কামনা পূর্ণ করেন বলেই এই মন্দিরের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন এই মন্দিরটি মুক্তেশ্বরী মন্দির নামেও পরিচিত। দেবী সতীর মুকুট এই স্থানে স্থানে পড়েছিলে বলে মনে করা হয় এই মন্দিরে বিশেষ কোন বিগ্রহের পূজা করা হয় না একটি কালো পাথরকেই বিগ্রহ রূপে পূজা করা হয়ে থাকে।
তারাপীঠে- দেবীর জাগ্রত হবার কাহিনী তো বহুল প্রচলিত। বহু দূর থেকে মানুষজন এখানে দেবীর চরণে পুজো দিয়ে মানত করতে আসেন। হিন্দুদের পবিত্র ৫১ পীঠের মধ্যে তারাপীঠ অন্যতম। সতীর চোখের মণি এখানে পড়েছিল। দেবী এখানে মা তারা রূপে পূজিত হন। শোনা যায়, আপনি আপনার জীবনের যেকোনো সমস্যা নিয়ে তারাপীঠে মা তারার কাছে আসুন, ফল পাবেনই।
কঙ্কালীতলা মন্দির, বোলপুর- ৫১ পীঠের অন্যতম শেষ পীঠ এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের নিকট অবস্থিত। এখানে দেবী সতীর কঙ্কাল অথবা কোমর পড়েছিল পড়েছিল বলে মনে করা হয়। অত্যন্ত জাগ্রত এই মন্দিরটি কোন বিগ্রহ বা প্রতিমা পুজো করা হয়ে থাকে না। ভক্তিভরে সারা বছর ধরে প্রতিটি আমাবস্যায় এই মন্দিরে পূজা দিয়ে যান হাজার হাজার হাজার ভক্তরা। কথিত আছে এই মন্দিরে দেবী সতীর কোমর পড়েছিল এবং সেই কোমরকে ভগবান শিব স্বয়ং এক কুন্ডের মধ্যে কুন্ডের মধ্যে মধ্যে এক কুন্ডের মধ্যে কুন্ডের মধ্যে মধ্যে গুপ্ত অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন।
দেবী সর্ব মঙ্গলা- কথিত আছে রাজা বিক্রমাদিত্য শব দেহের উপর বসে এই মন্দিরের দেবীকে তুষ্ট করেছিলেন। এছাড়াও জনমতে শোনা যায় এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। এছাড়াও কথিত আছে এক রাতের মধ্যেই এই খানে সাতটি পুকুর খনন করা হয়েছিল এবং এই পুকুরের মধ্যেই এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। এই মন্দিরের আরাধ্য দেবী সর্ব মঙ্গলা এখানে দেবীর অষ্টধাতুর। দশোভূজা মূর্তি দেখা যায় যদিও পোশাকের এবং আবরণী দিয়ে ঢাকা থাকে তার দেহ।
দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির- শুধু কলকাতা কেন, গোটা পশ্চিমবঙ্গেরই কালী ভক্তদের অন্যতম পছন্দের তীর্থস্থান এটি। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে মা কালীর পুজো করতেন। মা কালী নাকি তাঁকে দেখাও দিয়েছিলেন! তাহলে বুঝতেই পারছেন দক্ষিণেশ্বরের মাহাত্ম্য? তবে আমার আপনার মতো পাপী-তাপীদের মা দর্শন দেবেন না। সে আশা দুঃস্বপ্নেও করবেন না। আমরা সাধারণ মানুষ, সাধারণ প্রার্থনা নিয়ে মায়ের কাছে যান, পুজো দিন। মা পূর্ণ করে দেবেন আপনার সব প্রার্থনা। আপনার অভাব অভিযোগ—সব মায়ের পায়ে জানান। বলছি না, মা আছেনই। খালি হাতে ও খালি মনে—দু’টোর কোনোটা নিয়েই আপনাকে ফিরতে হবে না।
তাহলে আর মনের দুঃখ কীসের? সব কষ্ট ঝেড়ে একবার শুধু মা কালীর পায়ে আশ্রয় নিয়েই দেখুন। ভক্তিভরে তাঁকে প্রণাম করুন। মা আপনাকে ফেরাবেন না।