পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে ‘খেতে দেবার মুরোদ নেই অথচ কিল মারার গোঁসাই’, সম্প্রতি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে এই রকম ধারণা করা যেতেই পারে; ‘শিক্ষক রূপে অযোগ্য হলেও নাপিত রূপে যথাযোগ্য’।
বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন ‘লোহাপুর মহাবীর রাম মেমোরিয়াল হাই স্কুল’-এ ঘটে যাওয়া এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রতিবেদনের সূত্রপাত।
গত ১৯ নভেম্বর এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠরত কয়েকজন ছাত্রর শিশুসুলভ চপলতার সঙ্গে জুঝতে না পেরে যে নির্মম পদ্ধতির সহায়তা নিলেন, কিছু নির্বোধ অভিভাবক ও তস্য নির্বোধ রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা তার জয়ঘোষ করলেও তা যে প্রকৃত শিক্ষকতুল্য ব্যবহার নয় তা প্রথমেই বলে দেওয়া উচিত।
কয়েকজন ছাত্রর দোষ শুধু এইটুকুই ছিল যে তারা প্রধান শিক্ষক ও তাদের অভিভাবকদের কথা না শুনে নিজেদের পছন্দ মতো চুল কেটে ও রঙ করে বিদ্যালয়ে এসেছিল।
তারা কিন্তু সবাই বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক পড়ে উপযুক্ত বই খাতা নিয়েই বিদ্যালয়ে এসেছিল।
নিজের ইচ্ছা মতো চুল কাটা ও চুলে রঙ করার বাইরে তারা বিদ্যালয়ে এসে এমন কোনো গোলমাল করেনি যা অপরাধ যোগ্য।
তাহলে এমন কি হলো যে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককেই নিজের হাতে ছাত্রদের চুল কেটে নিজেকে ‘নাপিত’ হয়ে বিদ্যালয়কে ‘সেলুন’ বানাতে হলো !
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংবাদমাধ্যম এই খবরের যে ধারা সম্প্রচার দেখিয়েছিল বা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য শুনিয়েছিল, সেই বক্তব্যের সারমর্ম হলো প্রধান শিক্ষক মহোদয় আগে এই বিষয়ে অনেকবার ছাত্রদের এই জাতীয় চুল কেটে বিদ্যালয়ে আসতে নিষেধ করেছিলেন, ছাত্ররা তাঁর আদেশ শুনতে না চাইলে প্রধান শিক্ষক ওই ছাত্রদের অভিভাবকদের সাথেও নাকি কথা বলেছিলেন। প্রধান শিক্ষক এই কথাও নিজের মুখে স্বীকার করে জানান, ওদের বাবা মায়েরাই আমাকে বলেছেন আপনি যে পদক্ষেপ নেবেন আমরা তাকেই স্বাগত জানাব। আর এর পরেই নাকি প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলারক্ষার বাহানা দেখিয়ে নিজেকে ‘নাপিত’ প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হন।
এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে ওই এলাকার অতিবড়ো শিক্ষিত ব্যক্তিও মনে করে বলতে পারেননি, গত দশ বছরে কতজন ছাত্র এই বিদ্যালয় থেকে যোগ্য ছাত্র রূপে সুনামের সাথে পাশ করে বেরিয়েছে (এখানে স্টার মার্কস, লেটার মার্কস বা প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগ ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হচ্ছে না)।
সাধারণ জনগণ অনেকেই পরিস্কার ভাবে জানিয়েছেন, “এখান থেকে কিছু মাইল দূরে রয়েছে ‘শান্তিনিকেতন’ যেখানে এক সময় চালু ছিল প্রকৃতি পাঠ, আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষার প্রকৃত জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনোই চাননি ‘ভীতিজনক শিক্ষাস্থল’ তিনি শিক্ষাস্থলীকে ‘ভীতিশূন্য’ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে গুরুদেবের ‘ভীতিশূন্য শিক্ষাঙ্গন’-কে শিরোধার্য করে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারগুলো তৈরী করেছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা। অথচ এর পরেও প্রধান শিক্ষকের এই কার্যকলাপ সমর্থন যোগ্য নয়।”
এই প্রসঙ্গে আরো বলা যেতেই পারে ‘মন্তেস্বরী’ শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ার কথাও ‘খেলার মাধ্যমে পড়া’।
অর্থাৎ এই কথা সহজেই বলা যায় প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ না তো মানছেন ‘মন্তেস্বরী’ শিক্ষণের গোড়ার কথা না তো মানছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত ও ‘সরকার আরোপিত শিক্ষা ব্যবস্থা’।
প্রশ্ন তাহলে প্রধান শিক্ষক কেনো এমন অদ্ভুত কার্যকলাপে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন ?
এই বিষয়ে একটা সাক্ষাৎকারের কথা বলি, সচীনরমেশ তেণ্ডুলকর স্বনামে পরিচিত হয়ে যাওয়ার পর লব্ধ প্রতিষ্ঠিত একটা বিদেশী ক্রীড়া পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক তেণ্ডুলকরের ‘কোচ রমাকান্ত আচরেকর’-এর এক সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় শ্রী আচরেকর বলেছিলেন, “আমি তেণ্ডুলকরকে নতুন করে শিক্ষাদান করিনি, ওতে বৃথা কালহরণ হতো এবং ফলদায়ীও হতো না। আমি তেণ্ডুলকরকে তার স্বরূপে রেখেই কিছু ঘষামাজা করেছি মাত্র।”
রমাকান্ত আচরেকর বুঝেছিলেন প্রত্যেক শিশু জন্মগ্রহণ করার পর প্রথম শিক্ষা পায় তার জন্মদাত্রী মা, আপনজন ও চোখে দেখা সমাজ থেকে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ওই শিশুরা যখন ছাত্রছাত্রী হয় তখন তাদের জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটে ভগবান বা আল্লার দূত রূপী শিক্ষকদের। কিন্তু অনেক সময়েই এটা অনেক দেরিতে হয়ে যায় ফলতঃ সমস্ত কার্যই পণ্ডশ্রম হয়ে যায় যদি না এই শিক্ষককুল সঠিক চিন্তাভাবনা নিয়ে অগ্রসর হন।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ-কে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমার মিত্র বা শত্রু কোনটাই নন, ফলতঃ ইচ্ছাকৃতভাবে ওঁনার খুঁত ধরার ইচ্ছা বা ধৃষ্টতা কোনটাই নেই।
কিন্তু ছোট্ট একটা প্রশ্ন অবশ্যই করবো-প্রধান শিক্ষক মহোদয়, কিছুদিন আগে বেশ কিছু ব্যক্তি দাবী করেছিলেন বিদ্যালয়ের পরিবেশ ভারতীয় শিক্ষাঙ্গণের মতো করার স্বার্থে প্রত্যেক পুরুষ শিক্ষককে ধুতি পাঞ্জাবি ও মহিলা শিক্ষিকাদের শাড়ী ব্লাউজ পরে বিদ্যালয়ে আসতে হবে। শিক্ষক মহোদয়, এই দাবীর মর্যাদা আপনি আর আপনার শিক্ষক-শিক্ষিকাকুল রাখেন তো !
মাথায় রাখবেন ‘নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি আর পরের বেলায় দাঁতকপাটি’ নীতি চলতে পারেনা।
এর পাশাপাশি বুকে হাত রেখে আব্দুল হামিদ আপনি বলুন তো, শিক্ষক রূপে যে আপনারা চূড়ান্ত ব্যর্থ তা কী আপনি এবং আপনার শিক্ষক-শিক্ষিকাকুল স্বীকার করেন।
কেনো ছাত্রছাত্রীদের কাছে দিন দিন আপনাদের গ্রহণযোগ্যতা কমছে তা নিয়ে ভাবেন !
কেনো আপনাদের আদেশ একজন ছাত্রও হাসতে হাসতে অমান্য করে তা আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন !
শিক্ষক রূপে আপনারা নিজেরা কতটা যোগ্য কোনোদিন তার কোনো পরীক্ষা নিয়েছেন ?
আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করুন প্রধান শিক্ষক মহোদয়, কেনো আপনার কথা ছাত্রছাত্রীরা শুনছে না।
অত্যাচার নয় বরং প্রাণঢালা ভালোবাসা দিয়ে ছাত্র সমাজের মন জয় করুন।
যে দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষক শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য তার জীবন দিয়ে বুঝিয়েছেন, ‘মেরেছো কলসীর কানা তাই বলে কী প্রেম দেবো না’, সেখানে আপনার মতো প্রধান শিক্ষক বড়োই বেমানান।

Find out more: