স্বাধীন ভারতের প্রণেতা -স্থপতিগণ স্বপ্ন দেখেছিলেন দাঙ্গা, দেশভাগের ক্ষত মুছে ভারত আক্ষরিক অর্থে আধুনিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে । শত সহস্র বছর ধরে পাশাপাশি কাছাকাছি বসবাসরত ভারতবাসী একে অপরের মত , ধর্ম ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানজনিত বৈপরিত্যকে সহ্য করে , মেনে নিয়ে , এমন –কী পালনের মধ্যে দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের পথে অগ্রসর হবে । উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সবথেকে  বড়ো সাফল্য হলো তিন তালাকের অপরাধীকরণ , জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ ও রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করে কেন্দ্রশাসিত এলাকায় রূপান্তরিত করা , রাম মন্দির নির্মাণের সপক্ষে রায় , সর্বোপরি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, এনআরসি-র মধ্য দিয়ে সেই সহনশীল , সহিষ্ণু পরম্পরায় তারা বড়ো মাপের প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে । মুদ্রণ, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম-এর ভেতর দিয়ে বিদ্বেষজাত অসহিষ্ণুতার বাণী ভয়ঙ্কর শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করে এক বিপজ্জনক মাত্রায় প্রতিনিয়ত আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে প্রবেশ করছে । তাতে সারা দেশে ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। একথা সত্য যে , বিগত শতকের নয়ের দশকের রামমন্দির নির্মাণ পর্বের উগ্রতাকে পেরিয়ে তথাকথিত ‘ রাজনৈতিক হিন্দুত্বে’র ‘এক মহনীয় যজ্ঞ শুরু হয়েছে । ‘ উগ্র হিন্দু জাত্যাভিমানে’র পথ বেয়ে আধুনিক সময় ,  ‍আধুনিক প্রেক্ষিতে আধুনিক মননকে বিধর্মীর প্রতি দ্বেষ- বিদ্বেষের কানায় কানায় ভরিয়ে তোলার এক সর্বনাশী, কর্মনাশা প্রচেষ্টা অবিরামভাবে চলছে । এই প্রচেষ্টা  বহুল পরিমানে সফল হয়েছে। এখানেই আরএসএস-বিজেপির সবথেকে বড় সাফল্য।

এখন প্রশ্ন হলে , এর থেকে কি আমাদের রেহাই নেই ? পুরনো দাঙ্গার স্মৃতি , দেশভাগের যন্ত্রণা , অবিশ্বাসী বাতাবরণকে মুছে ফেলে আমরা কি একুশ শতকে মানুষ , মনুষ্যত্ব, মানবতার চিরায়ত মূল্যবোধে জারিত হয়ে নতুন ভারত নির্মাণের কথা ভাবতে পারি না ? যে ভাবনায় জনগণের মুক্তির প্রশ্নে ইহজাগতিক বিষয়গুলি প্রধান অবলম্বন আশ্রয় হয়ে উঠবে । ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর অর্থাৎ গণপরিষদের কাজ শেষ হওয়ার আগের দিন সভাধ্যক্ষ হিসাবে ড. বি.আর আম্বেদকর তাঁর মর্মস্পর্শী ভাষণে ভবিষ্যত সম্বন্ধে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন , তার দুটি অংশ প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্যযোগ্য ।
তিনি বলেছিলেন , এক . ভক্তি কিংবা যাকে বলা যেতে পারে বীরপূজা , ভারতের রাজনীতিতে এমন বিরাট একটা স্থান দখল করে রেখেছে যা বিশ্বের অন্য কোনও দেশের রাজনীতিতে দেখা যায় না । ধর্মের ক্ষেত্রে ভক্তির পথ ধরে হয়তো আত্মার মুক্তি সম্ভব । কিন্ত রাজনীতিতে ভক্তি বা বীরপূজা হল অধঃপতনের সুনিশ্চিত পথ , যার অবশ্যম্ভাবী পরিনাম একনায়কত্ব ।
দুই . ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজাতন্ত্র হয়ে উঠবে তখন তা : 
‘‘ এক দ্বন্দ্বর্দীন জীবনে প্রবেশ করবে । রাজনীতিতে থাকবে আমাদের সাম্য , কিন্ত আমাদের সামাজিক আর অর্থনৈতিক জীবনে থাকবে অসাম্য । রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা মেনে নেব যে , একজন মানুষ সমান একটি ভোট ,একটি মূল্য । কিন্ত আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমনই যে সামাজিক আর অর্থনৈতিক জীবনে আমার একজন মানুষ একই মূল্য এই নীতি অস্বীকার করেই চলব । এই দ্বন্দ্বজীর্ণ জীবন আমরা কতকাল মেনে চলব ? সামাজিক আর অর্থনৈতিক জীবনে এই অসাম্য আর কত দিন মেনে চলব ? যদি খুব বেশিদিন তাকে মেনে চলি ,তাহলে আমাদের রাজনৈতিক গণতন্ত্র অবধারিতভাবেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে ।
‘ আইনজ্ঞ –অর্থনীতিবিদ , নিম্নবর্গীয় জনজাতির আদর্শ নেতা এবং ভারতীয় সংবিধানের খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান তীক্ষ্ণধী’ , আধুনিক ভারতের অন্যতম স্থপতি ড. বি আর আম্বেদকর- কৃত ভবিষ্যতবাণী আজো আমাদের জীবনচর্যায় অভিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি । স্বাধীনতার ৭২ বছর পর তাঁর ভবিষ্যত সর্তক বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে ।“
সংবিধান প্রদত্ত জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের মৌলিক অধিকার নয় , বরং মৌলিক অধিকারের হরণের এক ভয়াবহ পরিবেশ রচনার প্রয়াসই যেন আজকের ভারতের অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে চাইছে ! ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে উদার মানবতাবাদী মূল্যবোধ । মানুষ হিসাবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ।

Find out more: