যাঁর লেখায় জীবনের জল ছবি ফুটে ওঠে, তিনি এখন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন। সময়কে ভাগ করে নিয়ে সবকিছুকে তাঁকেই সামাল দিতে হয়। তিনি লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আড্ডায় উঠে এলো জীবনের নানান গল্প। ইন্ডিয়া হেরাল্ড-এর প্রতিনিধি অর্পণ ঘোষ শুনলেন সেই গল্প।
(অফিসে অপেক্ষারত নতুন মুখের ভিড়, সেই সঙ্গে প্রডাকশন টিমের কাজের ব্যস্ততা। দ্রুত সামলে নিজের ঘরে। ঢুকেই মিষ্টি হেসে আতিথিয়তা, চায়ের সঙ্গে ছিল টাও। নিজের পছন্দের জায়গায় বসে শুরু হলো আড্ডা)
অর্পণ : এখন কতগুলো সিরিয়াল চলছে?
লীনা : (গড়গড় করে একবারও না থেমে সিরিয়ালের নাম বলে বলে)৫ টা।
অর্পণ : টিভি ধারাবাহিকের ছকে আটকে আফশোস হয় না কখনও ?
লীনা : (দৃঢ় কন্ঠে)না, আফশোস হয় না। কারণ আমার অন্য কাজ করার স্বাধীনতা আছে। টেলিভিশন অসম্ভব পাওয়ারফুল একটা মাধ্যম। দর্শকরা কানেক্ট হন। দর্শকরা যা চানা আমি আমার লেখার মাধ্যমে দেওয়ার চেষ্টা করি। অসংখ্য মানুষ দেখেন। এটা ভাবলে আর আফশোস হয় না।
অর্পণ : এই যে দর্শক যা চান, সেটা বোঝেন কী করে ?
লীনা : (আবারও সেই একই ভঙ্গিতে)প্রথমত অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয়ত আমি সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশি। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানুষ কী চান!
অর্পণ : সিরিয়ালের কাহিনিতে মেয়েদের সুবিচার উঠে এসেছে ... (প্রশ্ন শেষ করাই আগেই বলতে শুরু করলেন)
লীনা : (চোয়াল শক্ত করে) হ্যাঁ, কারণ আমি ওম্যান এমপাওয়ারমেন্টে বিশ্বাস করি। মেয়েরা যে কোনও অংশে কম নয়, সেই বার্তাটা আমার লেখার মাধ্যেমে দেওয়ার চেষ্টা করি। আর এটা থেকে যদি ১ শতাংশ মানুষের মাইন্ডসেট পরিবর্তন হয় সেটাই আমার পাওনা।
অর্পণ : কখনও অন্য ধারার কাহিনি লিখবেন ?
লীনা : (কনফিডেন্টলি) আমি তো সিনেমাতে একেবারে অন্য ধারার কাহিনি নিয়ে আসছি। ‘মাটি’ একটা আলাদ কনসেপ্ট, তারপর ‘সাঁঝবাতি’ (২০ ডিসেম্বর রিলিজ) একেবারেরই অন্য ধারার ছবি। এখানে আমি মেয়েদের সুবিচার পাওয়ার মতো কাহিনি লিখিনি, তবে টেলিভিশনে এই মুহূর্তে খুব যে একটা পরিবর্তন আনব সেটা ভাবিনি।
(ইতিমধ্যেই ফ্লোরে কে কী সংলাপ বলছে ফোনে সে খবর পৌঁছচ্ছে। উত্তর দিচ্ছেন সেই মতোই)
অর্পণ : বিদ্যা বালানের প্রথম বাংলা ছবি ‘ভালো থেকো’র চিত্রনাট্যকার আপনি, এখন আর বিদ্যার সঙ্গে কথা হয় ?
লীনা : তখনই আমার সঙ্গে কম কতাই হতো কাজের বাইরে। (কিছুটা ভেবে)এখন তো হয় না, তবে ভবিষ্যতে বিদ্যাকে নিয়ে ছবি করলে নিশ্চয় কথা বলব।
অর্পণ : তাহলে তো বাংলা সিনেমায় বিদ্যা বালানের কামব্যাকের সম্ভাবনা আছে ?
লীনা : (প্রচণ্ড হেসে) না না, আমি বলেছি সিনেমা করলে..(কথা শেষে আবারও হাসি)
জাম্প কাট
অর্পণ : আচ্ছা ঠিক আছে। টেলিভিশনে কাজ শুরু করার আগে রাজাবাজারে খালপাড়ের শিশুদের নিয়ে নাটক করেছেন...
লীনা : (কনফিডেন্টলি)হ্যাঁ, আসলে ওদের লেখাপড়া শেখানো নিয়ে একটা এনজিও ফর্ম করেছিলাম। সেই সঙ্গে নাট্য চর্চা হতো। ওরা আকাদেমিতেও নাটক করেছে। চেষ্টা করেছি লেখাপড়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক দিকটাও যেন ঠিক থাকে (কথা বলা শেষে কিছুটা আনমনে)
অর্পণ : বাসভাড়া না থাকায় হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন, তারপর আজকে ...
লীনা : (হাঁটু মুড়ে বসেছিলেন, পা দু’টো এবার একটু ছড়িয়ে বসলেন। অনেকটা স্বস্তির প্রতিচ্ছবি)
ইয়েস হেঁটে ফিরেছি। দেখুন একটা একটা করে ইঁট গেঁথে জায়গাটা তৈরি করেছি। কেউ এক ইঞ্চিও জায়গা ছাড়েনি। পরিশ্রম করেছি, কাজকে ভালবেসেছি। এভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই এটুকু বলতে পারি (কথা শেষ করে মোবাইলে চোখ)
অর্পণ : শিয়ালদহে রেলওয়ে কোয়ার্টারের দিনগুলোতে ফিরতে ইচ্ছে করে?
লীনা : (মুখে হাসি, কিছুটা নস্ট্যালজিয়ায়) ওই দিনগুলো একটা অন্যরকম ছিল। অনেক মানুষ আসতেন। কথা হতো, আড্ডা হতো। তবে আমি পিছনে ফিরে তাকাতে চাই না। যেটা হয়ে গেছে সেটা থাক। সামনে এগোতে হবে। সেটাই এখন লক্ষ্য (কথা শেষে প্রোডাকশন টিমের এক জনকে ডেকে একটা কাজের কথা বলে দিলেন)
জাম্প কাট ২
অর্পণ : এই একটানা লিখে যাওয়ার রহস্যটা কী ?
লীনা : (হাসতে হাসতে) আসলে অনেকটা দিনের অভ্যাস, আর যখন কোনও কাজ করি পুরো বিষয়টা ছকে ফেলি। তাই হয়ে যায়।
অর্পণ : টেনশন হয় যখন অন্য সিরিয়ালের TRP বাড়তে থাকে ?
লীনা : (প্রচণ্ড কনফিডেন্টলি) বিশ্বাস করুন টেনশন হয় না। আমার একটা কিলার ইন্সটিন্ক আছে। যে লিখে মারতেই হবে। আর আমি সেটা করি (ফোন আসে, নির্দেশ দিলেন কিছু একটা করার জন্য)
অর্পণ : ‘ইষ্টি কুটুমে’ একটি সিনের জন্য খুনের হুমকি পেয়েছিলেন ?
লীনা : (খুব হাসি) হ্যাঁ, তবে আমি ভয় পাইনি সিরিয়াসলি। ভাবলাম ঠিক পথে সিরিয়াল এগোচ্ছে। তারপর চিত্রনাট্যের কোনও পরিবর্তন আনিনি। আই অ্যাম অন দ্য রাইট ট্র্যাক (বলে আবার হাসতে শুরু করলেন)
অর্পণ : সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই বিভিন্ন পোস্ট দেখা যায়, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘গানের ওপার’-এর মতো সিরিয়াল আর হয় না!
লীনা : (অনেকটা শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে বোঝায়) আমার এখানে বলার আছে। আমি ওঁনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, প্রথমত, ‘গানের ওপার’-এর থেকে ‘শ্রীময়ী’ কোনও অংশে কম নয়। দ্বিতীয়ত, ঋতুপর্ণ ঘোষ টেলিভিশন খুব করম করতেন, উনি ফিচার করতেন। সেই দিক থেকে আমরা একেবারের টেলিভিশন কেন্দ্রিক। তাই আমাদের শুধু আরবান দর্শক ভাবলে হয় না, রুরাল ভাবতে হয়। ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গেলে সব ধরনের মানুষের কথা বলতে হবে। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পার্টিকুলার দর্শক একথা বলতে পারেন বলেই আমার মনে হয়।
অর্পণ : আচ্ছা বেশ! ইন্ডাস্ট্রিতে নতুনদের অভিনয় কখনও খারাপ লেগেছে ?
লীনা : (খানিকটা আশাহত) অনেকবার লেগেছে। আসলে কিছুদিন পরে খ্যাতি আসতে শুরু করলে মাথাটা ঘুরে যায় অনেকের। তখন আর অভিনয় থেকে ফোকাসটা হারিয়ে যেতে থাকে। আমি নাম বলতে চাই না তবে হ্যাঁ সত্যি খারাপ লেগেছে।
অর্পণ : নতুনদের জন্য কী টিপস দেবেন ?
লীনা : (অভিভাবকের মতো) অভিনয়টা আসল। পা টা মাটিতে রাখো। ফ্লোরে নিজের কাজ শেষ হলে মেক আপ রুমে না বসে থেকে সিনিয়রদের কাজটা দেখো, শেখো, ফোকাস ঠিক রাখো। কাজকে ভালবাসো।
অর্পণ : ‘মাস্টার পিস’ বেরিয়ে গেছে আপনার লেখনীতে ?
লীনা : (ভীষণ বিনম্র ভাবে) না, কারণ আমি এখনও শিখছি। একদিন হয়তো বেরবে মাস্টার পিস। সবাই চায় সেটা!
অর্পণ : এবার একেবারে অন্য টপিক, আপনার পছন্দের খাবার কী ?
লীনা : (খুব হেসে) ভাত ভাত ভাত। বাঙালি ভাত ছাড়া বাঁচতে পারে নাকি! তবে হ্যাঁ সবই খাই। মাংস একদম খাই না। মাছটা অল্প।
অর্পণ : মাছ তো বাঙালির প্রিয় খাবার
লীনা : (কিছুটা ডাউন ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে) হমমম, আসলে ওটা আমার একটা কী বলব একটা অন্য ভাবনা কাজ করে। একটা সময় তো মাছ কাটতে গিয়ে জল দিয়ে মাছটাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলাম। মানে বুঝতেই পারছেন আমি কী বলতে চাইছি। তাই আর কি...(আবারও মাথা নিচু করে)
অর্পণ : আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। রান্না ঘরে কী রান্না করতে ইচ্ছে করে ?
লীনা : (মজার ছলে) আমি কিন্তু প্রায় সব রান্নাই পারি। কেউ বিরিয়ানি খেতে চাইলে রাঁধতে পারি। তবে দুধ কচু আর চিংড়ি বানাতে খুব ইচ্ছে হয়। যদিও এখন আর দুধ কচু দেখতেই পাই না।
অর্পণ : ফুচকা কবে লাস্ট খেয়েছেন ?
লীনা : উফফফ। খুব ভালবাসি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়েছি। এমনকী যখন ইচ্ছে হয় আনিয়ে খাই। কোনও কথা হবে না। (লাজুক হাসি)
অর্পণ : পছন্দের পেন ?
লীনা : (একেবারে শিশুদের মতো) আমার না পছন্দের পেনে কোনও দিন আর লেখা হল না। কারণ, আমার যে পছন্দের পেন আছে লিখলেই মনে হয় কাবি ফুরিয়ে যাবে। পুরনো হয়ে যাবে। তাই এখন নরমাল যে পেন গুলো একটু তাড়াতাড়ি লেখা যায় ওই গুলোতেই লিখি। (হাসি)
অর্পণ : পছন্দের সিনেমা আছে যা বারবার দেখতে ইচ্ছে করে ?
লীনা : (স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে) সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা আমার খুব পছন্দের। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা। ‘মেঘ ঢাকা তারা’ যে কতবার দেখেছি... প্রসেনজিতের কিছু সিনেমা বেশ লাগে।
অর্পণ : বর্তমানে টলিউডে প্রিয় অভিনেতা, অভিনেত্রী ?
লীনা : (কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে) অভিনেতা বললে শাশ্বতর অভিনয়, ঋত্বিকের অভিনয় ভালো লাগে। পরমব্রত ভালো করছে। হয়তো অনেকের নাম মিস করলাম। সরি। আর অভিনেত্রীদের মধ্যে পাওলির অভিনয়। না, আমার ছবিতে অভিনয় করেছে বলে নয়, আপনি এই প্রশ্নটা করতেই পারতেন তাই উত্তরটা দিয়ে দিলাম। (প্রচণ্ড হাসি, আর হাসতে হাসতেই উত্তর) আরও কয়েক জনের অভিনয় ভালো লাগে। নামগুলো ভুলে যাচ্ছি।
অর্পণ : নেক্সট প্রজেক্টে বাংলাদেশের কোনও অভিনেত্রীকে দেখা যাবে ?
লীনা : প্রশ্ন তো তৈরি। না প্লিজ বলব না। (হাসি)
অর্পণ : তাহলে তো ...
লীনা : (স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে) না না কথা হয়েছে। কিছু ফাইনাল হয়নি। তবে জয়া এহাসানের সঙ্গে নেক্সট প্রজেক্ট হতে পারে। আবারও বলছি এখনও কিচ্ছু ফাইনাল হয়নি।
অর্পণ : আচ্ছা ঠিক আছে আর জিজ্ঞাসা করব না। টপিক চেঞ্জ। মহিলা কমিশনে যান তো..
লীনা : (সিরিয়াসলি)হ্যাঁ, তিন দিন যাই, বাকি দিন ফিল্ড ওয়ার্ক।
অর্পণ : ম্যানেজ করেন কী করে ? ঘুমানই বা কতক্ষণ ?
লীনা : প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লেখা। তারপর মহিলা কমিশন। কাজ সেরে সন্ধ্যায় এখানে অফিসে। চলল অনকক্ষণ। তাই ঘুমটা কমই হয়।
অর্পণ : মন খারাপ হলে কী করেন ?
লীনা : বই পড়ি। অগুন্তি বই পড়েছি...
অর্পণ : পছন্দের ঘোরার জায়গা ?
লীনা : (মুখটা ব্লাশ করতে লাগল) শান্তিনিকেতন। আমার বাড়ি আছে ওখানে। শান্তিনিকেতন সময় পেলেই যাই।
অর্পণ : ‘সাঁঝবাতি’র জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল
লীনা : থ্যাঙ্কু ইউ ভেরি মাচ অর্পণ
(আবার শুরু করলেন তাঁর লেখনীতে জীবনের জলছবি আঁকার কাজ।)