বর্ধমানের খাগড়াগড়ে একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়। পুজোর সময় রাজ্যে বিস্ফোরণের ঘটনায় স্বভাবতই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। ঘটনায় নিহত হয় দুজন, নদীয়া জেলার বাসিন্দা শাকিল আহমেদ ও সোভান মণ্ডল। গুরুতর জখম হয় আবদুল হাকিম। বাড়ির মালিক নুরুল হাসান চৌধুরী ছিলেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতা, তবে তিনি বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন শাকিলকে। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শাকিল। পরে মারা যায় সোভান। পুলিশ শাকিল ও আবদুলের স্ত্রীকে গ্রেফতার করে।
সেসময় ওই বাড়ি থেকে ৫৫টি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস, আরডিএক্স, বোমা তৈরির অন্যান্য সরঞ্জাম, ও সিম কার্ড উদ্ধার করেছিল পুলিশ। বিস্ফোরণের ঘটনার পরই পুলিশ ও দমকলে প্রথম খবর দেন স্থানীয় বাসিন্দারাই।
এই ঘটনা অনেকের কাছেই জ্ঞাতব্য। তবে যেটা না জানার সেটা হল— ‘দম্পতি মডিউল।’ সূত্র মারফৎ যতটুকু তথ্য জানা গিয়েছে তা হল - ভিন দেশ বিশেষত বাংলাদেশ থেকে জামাতুল মুজাহিদিনের সদস্যরা এ রাজ্যে আসত নাশকতা মূলক কাজ- কর্মের জন্য। সেই সঙ্গে ভিন রাজ্যে বিষ্ফোরক পাচার করা ছিল তাদের অন্যতম কাজ। সাধারণত এই সব কাজের জন্য জঙ্গিরা বেছে নিত বর্ডার সংলগ্ন এলাকা। কারণ, প্রয়োজনে বা বিপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়া। খাগড়াগড় সেই কারণে পছন্দের ছিল জঙ্গিদের। আর এ রাজ্যে তারা আসত দম্পতি হিসাবেই। কারণ খাগড়াগড় বিষ্ফেরণের আগে সচারচর এই মডেল তদন্তকারীরা খুব একটা দেখেননি। এই মডেলের বৈশিষ্ট হল, স্বামী-স্ত্রী এবং বাচ্চাকে নিয়ে এক নিপাট গরীব ফ্যামিলি পার্সেন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। যাতে ভাড়া বা অন্যান্য সুবিধা পেতে অসুবিধা না হয়। এরপর নির্বিঘ্নে ঘর ভাড়া নিয়ে আশপাশের মানুষকে দর্জি বা কাপড় বিক্রেতা পরিচয় দিয়ে নিজের জেহাদি কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া। যেটা করত শাকিল, আবদুল আর সোভানের মতো জেএমবি জঙ্গিরা। না, এখানেই শেষ নয়। এদের স্ত্রীরাও প্রশিক্ষিত জঙ্গি। যাদের ট্রেনিংই হয়েছিল সংসার বলে কিছু নেই। যে কোনও পরিস্থিতিতে জেহাদি পরিচয়ের ছাপ রেখে দেওয়া। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, বিষ্ফোরণের পর কান্নায় ভেঙে না পড়ে নমুনা নষ্ট এবং মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত পরিষ্কার করা। হ্যাঁ, এই ঘটনাই ঘটেছিল খাগড়াগড়ের ওই বাড়িতে। সূত্র মারফৎ এই খবরই পাওয়া গিয়েছিল।
আবার জেহাদি কার্যকলাপের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাও। যেমন শিমুলিয়ার মাদ্রাসা। ঘটনার পরে যা সিজড করেছিল পুলিশ। সেই মাদ্রাসায় পাওয়া গিয়েছিল জেহাদি সম্পর্কিত বইও। শুধু তাই নয় ওই মাদ্রাসার ঘর দেখে কার্যত বিস্মিত হয়েছিলেন তদন্তরারীরা। ঘরগুলির জানালা ছিল জমির আলের থেকে সামান্য উঁচু। অনুমান ওখান দিয়েই বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এমনকী বিপদে হাঁটু মুড়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য আলের রাস্তাও তৈরি করা ছিল যা মিশেছে বর্ডার পার হওয়ার জন্য বড় রাস্তায়।
তদন্ত এখনও চলছে। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় আরও এক জেএমবি জঙ্গিকে। কেরালার মল্লাপুরম এলাকা থেকে আব্দুল মতিন নামে এই জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে এসটিএফ। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরই এ রাজ্য থেকে পালিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল মতিন। এসটিএফ সূত্রে জানা গিয়েছে, আদতে আসামের বরপেটা জেলার বাসিন্দা মতিন। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের জন্য শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদ্রাসায় যে ১৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম মতিন। ২০১০ সাল থেকে মতিন জেএমবি—র সঙ্গে যুক্ত বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। নাসিরুদ্দিন, মৌলানা ইউসুফ, সইদুল, জাহিদুলদের পরিচিত মতিন।
শেষে আসি এনআইএ অর্থাৎ ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশম এজেন্সি প্রসেঙ্গে। ২০১৪ সালে এই ঘটনা ঘটার পরই এ রাজ্যে প্রথম আসে এনআইএ। এই তদন্তকারী সংস্থার কাজ এবং নাম সম্পর্কে অনেকেই পরিচিত ছিলেন না। তবে জঙ্গি এবং খাগড়াগড় কাণ্ডের পর এই জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা জঙ্গিদের চালচিত্র খুলে দিয়েছিল। যা বড় ধাক্কা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে।