মুখ দেখে রোগীর চিকিৎসা করতেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে ১৯৩০ সালে ইংরেজ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন দিল্লি থেকে। তারপর তাঁকে আনা হয় কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। জেলে ওই সময় বন্দি ছিলেন বর্ধমানের এক গান্ধীবাদী শিক্ষক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য। বিজয়বাবু লিখেছেন, তিনি বর্ধমান জেলে থাকাকালীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওজন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। সর্ব ক্ষণ জ্বর থাকত। এই সময় তাঁকেও আনা হয় আলিপুর জেলে।


বিধান রায় জেলে এসেছিলেন প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় সশ্রম কারাদণ্ড চেয়ে নিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। সাধারণত এটা করা যায় না, কিন্তু সম্ভবত বিধান রায়ের ব্যক্তিত্বের সামনে ওঁরা না বলতে পারেননি। ফলে ডাঃ বিধান রায়ের ডিউটি পড়ল জেলের হাসপাতালে। কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল জেলে রোগীর মৃত্যুসংখ্যা কমে গেছে। নিউমোনিয়া, টাইফায়েড ইত্যাদি কিছু কঠিন অসুখের ওষুধ জেলে থাকত না, সে সব বিধান রায় তাঁর দাদা সুবোধ রায়ের মাধ্যমে বাইরে থেকে নিজের টাকায় আনাতে শুরু করলেন। প্রায়ই দেখা যেত ছ’ফুট ছাড়ানো লোকটা স্টেথো গলায় দিয়া জেলের হাসপালে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, পেছন পেছন চলেছেন জেলের সরকারি ডাক্তার।


গান্ধীবাদী সেই শিক্ষক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন, “বিধানবাবু চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমার বিছানার পাশে বসলেন। মিনিট কয়েক চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর অসুখ নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। মুখের দিকে তাকালাম। একটু যেন চিন্তিত বলে মনে হল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মুখখানা আবার প্রফুল্ল হয়ে উঠল। হেসে বললেন, ‘কিছু না। সেরে যাবে।’ মনে হল এর মধ্যেই অসুখের সব কিছু বুঝে ফেলেছেন। বিজয়কুমার ভট্টাচার্যই এরপর জানিয়েছেন,  কোনও রোগীর চিকিৎসা শুরুর আগে বিধান রায় কিছু ক্ষণ সেই রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তিনি রোগ নির্ণয় করতেন। 
ওই জেল হাসপাতালে তখন ১১০ জন রোগী। একদিন জেলের ডাক্তার বঙ্কিমবাবু (উপাধি লেখেননি বিজয়কুমার ভট্টাচার্য) কোনও কারণে আসতে দেরি করছেন। বিধান রায় একাই এক এক করে ১১০ জন রোগীকে দেখলেন। তার পর ছুটতে ছুটতে বঙ্কিমবাবু এসে হাজির। কাঁচুমাঁচু মুখে বন্দি বিধান রায়কে বলছেন, স্যার একটু দেরি হয়ে গেল। বিধান রায় হেসে বললেন, না না ঠিক আছে, রোগী আমি দেখে নিয়েছি, আপনি ওদের টিকিটগুলো আনুন, পথ্য আর ওষুধটা আমি বলে দিচ্ছি। বিজয়কুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন, তিনি অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, আধঘণ্টা আগে দেখা ১১০ জন রোগীর প্রত্যেকের জন্য ওষুধ, পথ্য প্রায় মুখস্থ এক এক করে বলে গেলেন ডাঃ বিধান রায়। এমনই অসামান্য স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর।


বিধান রায় জেলে থাকাকালীন পেয়ে গেলেন বন্দি কানাই গাঙ্গুলিকে। কানাইবাবু ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডক্টরেট করেছিলেন জার্মানি থেকে। খুব ভালো জার্মান ভাষা জানতেন তিনি। তিনি বরিশালের শঙ্কর মঠের স্বামী প্রজ্ঞানন্দের বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। পরে গ্রেফতার হন ব্রিটিশ পুলিশে হাতে। এই কানাই গাঙ্গুলির কাছে জেলের ভিতর বিধান রায় শুরু করলেন জার্মান ভাষা শেখা। এই নিয়ে কানাইবাবু লিখেছিলেন, ছ’মাস জেলে থাকাকালীন বিধান রায় একদিনও বাদ দেননি জার্মান শেখার ক্লাস। এবং যখন জেল ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তাঁর এই বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়ে গেছে।
জেলে বিধান রায়ের খাবার আসত ওয়েলিংটনের বাড়ি থেকে। আলিপুর জেলে তখন সিনিয়র ডেপুটি জেলার ছিলেন রায় সাহেব অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। সব রাজনৈতিক বন্দির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী বাড়ি থেকে খাবার এলে আগে তা ‘টেস্ট’ করে দেখবেন ডেপুটি জেলার। তার পর তা বন্দিকে দেওয়া হবে। এক রাতে অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে বসে খবর পেলেন, বিধান রায়ের খাবার আসেনি। ছুটে গেলেন জেলে। গিয়ে দেখলেন, খাবার এসেছিল, কিন্তু তা এত সুস্বাদু ছিল যে টেস্ট করতে করতে সবটাই খেয়ে ফেলেছেন ডেপুটি জেলার। লজ্জার মাথা খেয়ে অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান রায়ের ঘরে গিয়ে সব জানালেন। বিধান রায় হেসে বললেন, আগে বললে তো আমি ওর জন্যেও খাবার পাঠাতে বলে দিতাম। অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান রায়কে বললেন, তিনি বিধান রায়ের বাড়িতে ফোন করে দিয়েছেন, নতুন করে খাবার পাঠানো হচ্ছে। সেই খাবার এল রাত ১১টায়। বিধান রায় খেলেন। তার পর বাড়ি গেলেন রায় সাহেব অনিলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

কেনেডির সঙ্গে বিধান রায়ের মিটিং চলছে। মিটিং শেষে বিধান রায় বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমার মনে হচ্ছে আপনার পিঠে মারাত্মক পেইন আছে।
কেনেডি অবাক বিস্ময়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, How do you know that?
বিধান রায় বিনীতভাবে বললেন, আমি পেশায় ডাক্তার, নেশায় রাজনীতিবিদ।
কেনেডি তাঁর সেক্রেটারিকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল কাগজ বিধান রায়কে দেখাতে বললেন।


তিনি দেখলেন এবং আমেরিকার চিকিৎসার মান দেখে অসন্তুষ্ট হলেন। বিধান রায় নতুন করে প্রেসক্রিপশন দিলেন। দৃঢ়চিত্তে বললেন, এগুলো নিয়ম করে খাবেন। না সারলে আমাকে জানাবেন। আমি আবার আসবো আমার নিজ খরচে।
মিটিং শেষে বিদায় নেয়ার আগে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট আমার ফী তো দিলেন না!


কেনেডি জানতে চাইলেন, কত দিতে হবে ফী?
বিধান রায় মওকা পেয়ে পশ্চিম বঙ্গের উন্নয়নের জন্য ৩০০ কোটি টাকা চাইলেন। সাথে সাথে মঞ্জুর করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মোরারজী দেশাই খুব চটলেন। একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এভাবে একটা দেশের প্রেসিডেন্টের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন না।
নেহরু বললেন, ওকে ক্ষেপিও না। ও নিজে মঞ্জুরি এনেছে। টাকা দিয়ে দাও।


আজ যখন একজন মুখ্যমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন, তখন এই ইতিহাসটা মনে পড়লো।


Find out more: