আজ ৫ সেপ্টেম্বর ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম প্রথম সারির দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন । আর এই দিনটি ওই মহান শিক্ষকের প্রতি সম্মান জানিয়ে সমগ্র দেশজুড়ে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয় । প্রতি বছর এদিন রাজধানী দিল্লিতে দেশের কিছু শিক্ষককে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয় । এই পুরস্কার রাষ্ট্রপতি তুলে দেন শিক্ষকদের । আর আমাদের রাজ্যে শিক্ষারত্ন তুলে দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় । শিক্ষকদের জাতীয় পুরস্কার এবং রাজ্যের শিক্ষারত্ন পুরস্কার পেতে হলে আসলে কী যোগ্যতা লাগে তা এখনও স্পষ্ট নয় ।
কিসের ভিত্তিতে এই দুটি পুরস্কার দেওয়া হয় তা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন দিন । জাতীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রে কিছুটা বাছাই করা হয় বলে মনে হয় । কিন্ত শিক্ষারত্ন কিভাবে দেওয়া হয় তা আজও জানা গেল না । যে শিক্ষক তাঁর স্কুলে ছাত্রকে বেশি নম্বর পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেন তিনিও শিক্ষারত্ন । এমনও শিক্ষক আছেন যার বিরুদ্ধে মহিলাদের উত্যক্ত করার অভিযোগ আছে তিনিও শিক্ষারত্ন । আর নিরবে নিভৃতে ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নয়নে , সার্বিক বিকাশে কাজ করে যাচ্ছেন যাঁরা তাদেরকে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার।
শিক্ষক মানে সমাজের অভিভাবক । ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো যেমন শিক্ষকদের কাজ । তেমনি সমাজ কোন পথে পরিচালিত হবে তার দিকনির্দেশ করাও শিক্ষকের কাজ । শিক্ষকরা সমাজের সম্মানীয় মানুষ । কিন্ত তাঁদের নানা যাঁতাকলে পিষে রস বের করে নেওয়া হচ্ছে । সরকার তাঁদের উপর কন্যাশ্রী ,থেকে শুরু করে নানা রকম স্কলারশিপের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে । ফলে তাঁদের মূল কাজ পড়াশোনা করানোর চেয়ে সরকারের প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করা প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে ।
তারপর রয়েছে শাসক দলের চাপ । রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস কোনো সময় শিক্ষকদের আস্থা পায়নি । কারণ অবশ্য আছে । তৃণমূলের শিক্ষক নেতারা বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় যান না । কেউ বিকাশ ভবনে আর কেউ মহাকরণে মন্ত্রীদের কাছে সময় কাটাতে বেশি ব্যস্ত । এই কারণেই তৃণমূল শিক্ষক সংগঠন প্রসারিত হয়নি । আর এটা না বুঝে এলাকার তৃণমূল দাদারা নানাভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষকদের বিরুদ্ধাচারণ করে চলেছেন । ফলে অশান্তি হচ্ছে । শিক্ষকরা পড়াশোনা না করিয়ে এই অশান্তি মেটাতে চেষ্টা করছে ।
যেমন মাসুম আখতার । প্রথম থেকেই প্র্রতিবাদী মুখ । দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিসাবে তিনি কাজ করেছিলেন । সেখানে মিডডে মিল নিয়ন্ত্রণ করতেন তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা । তা নিয়ে বিরোধ । শেষ পর্যন্ত মাসুম আখতারকে ওখান থেকে চলে আসতে হয় । তারপর কলকাতার লাগোয়া একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগ দেন । প্রথম থেকে তিনি দেখেন কিছু ছেলে মাদ্রাসার ছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করছে । তার বিরোধিতা করার জন্য । মিডডে মিলে কিছু মিশিয়ে দেয় স্থানীয় কয়েকজন । ফলে সেই মিডডে মিল খেয়ে ছেলেমেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়লে হামলা হয় প্রধান শিক্ষক মাসুম আখতারের উপর । এই হামলার নেপথ্যে ছিল তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা । অপরাধ পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া ।
এরপর তিনি মাদ্রাসায় নাকি জাতীয় সংগীত গাওয়াতে চেয়েছিলেন । তার বিরোধী এলাকার সবাই ছিল । ফলে জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর অপরাধে হামলা হয় মাসুম আখতারের উপর । পরবর্তী কালের ঘটনা সবার জানা । তিনি এখন যাদবপুর এলাকার একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে চাকরি করছেন । সব মিলিয়ে রাজ্যের শিক্ষকদের অবস্থা ওই মাসুম আখতারের মতই । আমি নিজেও একজন শিক্ষক । সেখানে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার পক্ষে সওয়াল করার অপরাধে তৃণমূল নেতাদের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছিল । এটাই হচ্ছে রাজ্যের শিক্ষকদের উপরি পাওনা । আজ শিক্ষক দিবসের দিনে ভালো কথা শোনাতে পারিনি বলে দুঃখিত । কেননা রাজ্য জুড়ে শিক্ষকদের উপর যে তৃণমূলের এক শ্রেণির নেতার ন্যাক্কারজনক ভূমিকা কাজ করছে তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি ।