আমেরিকার হিউস্টন শহরে হাউডি মোদীর সভায় উজ্জ্বল আলোয় আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে ফুলঝুরি ঝড়বে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই । আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যে আবেগ থাকে ; তাতে কী বাস্তবতা থাকে ? তা না হলে কথায় কথায় বিরোধীদের দেশদ্রোহী বলাটা বিজেপি দলের নেতাদের স্বভাবে পরিণত হত না । একইভাবে দেশের আর্থিক অবস্থার হাল ফেরাতে কি ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার তা এখনও জানা যায়নি ? বরং নোট বন্দী করার পর দেশের আর্থিক অবস্থা যে খারাপ হবে তা নিয়ে তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন । তা সত্ত্বে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি আমাদের শাসক দলের মধ্যে । বরং তাঁরা স্বচ্ছতার দাবি করা হয়ে থাকেন । বলা হয় , মোদীজির আমলে দেশ নাকি দূনীর্তি মুক্ত হয়েছে ।
দূনীর্তি মুক্ত হয়েছে কিনা তা এখনই বলা যাবে না , তবে দেশের আর্থিক অবস্থার হাল যে শোচনীয় হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । গরীব –দরিদ্রদের কথা না হয় বাদই দিলাম দেশের মধ্যবিত্ত সমাজে দেশের আর্থিক পরিস্থিতির যে প্রভাব পড়বে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই । সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই সরকারের । আর্থিক বিকাশ কীভাবে তরান্বিত করা যাবে তা নিয়ে গঠনমূলক কোনো চিন্তা ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না । মোদীজি দাবি করে থাকেন ৭০ বছরে তিনিই নাকি প্রথম দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন । দেশ সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ঠিক বলে থাকেন ৭০ বছরে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী যার আমলে বাজেট সংসদে পাশ হওয়ার পরও প্রতি মাসেই সেই বাজেটের আপডেট চলতে থাকে । কোনো দিশা নেই । দিশাহীন , আর্থিক দিক থেকে কোনো পরিকল্পনাহীন সরকার যা করে থাকেন তাই করে চলেছেন মোদী সরকার।
দেশে ক্রমাগত বেকার সংখ্যা বেড়ে চলেছে । একের পর এক শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । উৎপাদনমুখী শিল্প সংস্থাগুলি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে । তাদের সামনে কোনো পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হতে দেখা যাচ্ছে না সরকারকে। শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে । দেশের আর্থিক হাল যখন তলানি চলে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কর্পোরেট করে ছাড়ের কথা ঘোষণা করলেন ।
আর অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই প্রধানমন্ত্রী সেই আবেগময় ভাষণ । তিনি বললেন , অর্থমন্ত্রীর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির চাকা এবার দ্রূত গড়াতে শুরু করবে । আসলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের ছায়া স্পষ্ট । তিনিও ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন স্বর্ণমূদ্রা বাতিল করে তামার মূদ্রা চালু করার মধ্য দিয়ে । আর মোদীও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন জাল নোট আটকাতে গিয়ে নোটবন্দী করলেন । আর তাতেই আরও বেশি করে জাল নোটে বাজার ছেয়ে গেল । বিন তুঘলকের আমলে তামার নোট নিতে প্রজা রাজী হয়নি । ঠিক তেমনভাবেই ছোট এক টাকার কয়েন নিতে রাজী হচ্ছে না সাধারন মানুষ । অন্যদিকে নতুন একশো টাকা , পঞ্চাশ টাকা নোটের হাল দেখলে ভারতের আর্থিক বিকাশের হার স্পষ্ট হয়ে যাবে ।
এতে অবশ্য মোদীজির কোনো দোষ নেই কারণ তিনি না জেনে এই কাজগুলি করেছেন । তিনি ভেবেছেন এতে দেশের ভাল হবে । একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক হিসাবে তিনি এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছিলেন । যেমন মুহাম্মদ বিন তুঘলক দেশের স্বার্থে তার রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বর্ণমূদ্রা বাতিল করে তামার মূদ্রা চালু করেছিলেন , রাজধানী পরিবর্তন করেছিলেন । তাতে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হলেও তার উদ্দেশ্য যে ভাল ছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।
তাই মোদীজির উদ্দেশ্য নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই । তিনি একজন দেশপ্রেমিক হিসাবে দেশের স্বার্থেই নোটবন্দী করেছিলেন । কিন্ত বিষয়ের ভয়াবহতা বুঝে উঠতে পারেননি । তিনি রাজনীতির নামে চোর –ডাকাতদের দমন করতে চেয়েছিলেন । উদ্দেশ্য ভাল । কংগ্রেস এই ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি ঠিকই ,তাদের আমলে দূনীতি হয়েছে স্বজন পোষণ হয়েছে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে , তাদের আমলে দেশের মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে হয়নি । আজ ব্যাঙ্কে কিংবা এলআইসিতে টাকা রেখে সেই টাকা গ্রাহক ফেরত পাবে কিনা তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে । দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে । অথচ মোদীর ভাষায় চোরের দল কংগ্রেসের আমলে এই সংশয় ছিল না । মানুষ অন্তত ব্যাঙ্ককে বিশ্বাস করত ।
যাইহোক , অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট করে ছাড়ের কথা ঘোষণা করার পর তিনি দাবি করেছেন দেশের আর্থিক গতি বৃদ্ধি পাবে । প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে দেশের আর্থিক পরিস্থিতির ভোল পাল্টে যাবে । কিন্ত সত্যি কী তাই ? এটা সম্ভব । বাজেট পাশ হয়ে যাবার পর কর্পোরেট করে ছাড় ঘোষনায় যে ১ .৪৫ লক্ষ।
কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে কম জমা পড়বে তা কোথা থেকে পূরণ করবে সরকার ? সীতারামনের যুক্তি, এতে সংস্থাগুলির নিট আয় বাড়বে। ওই বাড়তি টাকা বিনিয়োগ করবে তারা। লগ্নি বাড়লে, কাঁচামালের চাহিদা বাড়বে। সঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আবার কল-কারখানায় কাজের সুযোগ এবং মজুরি বাড়লে, লোকের হাতে টাকা আসবে। ফলে বাড়বে কেনাকাটা। সব মিলিয়ে, চাঙ্গা হবে অর্থনীতি। এনিয়ে ডিজিটাল আনন্দবাজারে বিস্তারিত লেখা হয়েছে এক প্রতিবেদন । সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ,কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, যদি হাতে টাকা না-থাকার কারণে শিল্প লগ্নি করতে না পারে, তবে হয়তো এই যুক্তি খাটে। কিন্তু যেখানে চাহিদাই বাড়ন্ত, সেখানে কর কমার দরুন হাতে আসা বাড়তি টাকা নতুন করে বিনিয়োগের কথা ভাববে কোন শিল্প? এর থেকে সাধারণ মানুষের হাতে সরাসরি টাকা যাওয়ার মতো সরকারি প্রকল্পে এই অঙ্ক ঢালা হলে, সেই ওষুধ অনেক বেশি কার্যকরী হত বলে মনে করছেন তাঁরা।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটকের অভিযোগ, ‘‘দেশ যখন গভীর মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন কর্পোরেটের জন্য এই কর ছাড় আসলে ধনীদের জন্য পুনর্বণ্টন। অথচ দরিদ্রদের জন্য কোনও প্রকল্পের কথা হলেই কর্পোরেট মুখপাত্ররা প্রথমেই তাকে সমাজতন্ত্র বলে উড়িয়ে দেন!’’ তাঁর মতে, সেনসেক্স বাড়লে তো চাহিদা বাড়ে না। তাই এর বদলে পরিকাঠামোয় সরকারি ব্যয় বাড়লে যে বাড়তি কাজের সুযোগ তৈরি হত, তা-ও অনেক কাজের হত।
অর্থনীতির অধ্যাপক পিনাকী চক্রবর্তী মতে, গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের কথা। তাঁর মতে, এই ধরনের প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বাড়লে বরং গরিব, সাধারণ মানুষের হাতে কিছুটা টাকা আসত। বাড়ত চাহিদা। আর চাহিদার দেখা মিললে, তবেই তো লগ্নিতে আগ্রহী হবেন শিল্পপতিরা। নইলে কর ছাঁটাইয়ের দরুন সংস্থার নিট আয় বা মুনাফা হয়তো বাড়বে। কিন্তু সেই বাড়তি টাকা ঢালতে কিছুতেই আগ্রহ দেখাবেন না তাঁরা।
এ কথা স্পষ্ট কেন্দ্র কর্পোরেট করে ছাড় ঘোষণা করে আরও একটি ঐতিহাসিক ভুল করল বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন । তাঁদের মতে এর চেয়ে গরীব – নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থে কোনো সামাজিক প্রকল্পে বড় ধরনের অর্থনীতি বিনিয়োগ করলে তাতে আর্থিক বিকাশে সরাসরি প্রভাব পড়ত। সাধারন মানুষের হাতে টাকা থাকলে ক্রেতা বাড়ত , বাড়লে উৎপাদন বাড়ত । ফলে দেশের আর্থিক বিকাশ তরান্বিত হত। তা না করে যে বিশাল অংকের কর ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হল তাতে কোনো আশার আলো দেখা যাবে না বলেই মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা । দেশ এক গভীর আর্থিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে ।