প্রাইভেট অপারেটররা যাতে ফাইভ জি সার্ভিসে নিজেদের তুলে আনতে পারে হাই ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রাম তাদের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা চলছে আর বি এস এন এল-কে আটকে রাখা হয়েছে থ্রি জি-র স্তরে তাই বি এস এন এলের আর্থিক ক্ষতি ছিল অনিবার্য। ৬ পয়সার খেলা ।আপনি যদি জিও-র গ্রাহক হন এবং প্রতিদিন যদি অন্য সার্ভিস প্রোভাইডারের গ্রাহকের ফোনে ১ঘন্টা বা ৬০ মিনিট কথা বলেন তবে
১ দিনে খরচ ৬০x ৬ পয়সা=৩৬০প: বা ৩টা৬০প:
১ মাসে খরচ ৩.৬০x৩০=১০৮ টাকা
দেখুন BSNL এ ১০৮ টাকা দিয়ে মাসে রিচার্জ করলে অানলিমিটেড কল করতে পারছেন।
তাহলে জিওর ৩ মাসের প্ল্যান ৩৯৯টাকার সঙ্গে অাপনাকে বাড়তি ১০৮×৩= ৩২৪ টা: খরচ করতে হচ্ছে।
তাহলে ৩ মাসে জিওতে মোট খরচ = ৩৯৯+৩২৪=৭২৩ টাকা
BSNL এ ৪৮৫ টাকায় রিচার্জ করলে ৩ মাস অানলিমিটেড ডেটা প্যাক এবং অানলিমিটেড কল।
এবার নিজেরাই বিচার করুন BSNL কে সমান সুযোগ দিয় বাজারে প্রতিযোগিতা করতে দিলে এই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাটি আজ কোথায় পৌঁছত।
ভারতের টেলিফোনির বাজারে বর্তমানের তিন প্রধান খেলোয়াড় জিও, এয়ারটেল আর ভোডাফোন। বর্তমানে বাজারের সিংহভাগ এই তিন কোম্পানির দখলে। আবার জিও-র দাপটে এয়ারটেল আর ভোডাফোনও খুব চাপে পড়ে যাচ্ছে। আর সরকারি বি এস এন এল আর এম টি এন এলের কথা তো উঠতেই পারে না। সরকারি মাল মানেই যে ফালতু সেটা সদ্যজাত শিশুরাও জানে। তাহলে আসুন, আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক।
আপনার-আমার হাতের মোবাইল সেটে তার থাকে না বলেই যেখানে সেখানে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারি। মোবাইল টাওয়ার দেখে হয়তো ভাবেন, বেতার ব্যবস্থা প্রাইভেট কোম্পানির গুণে আপনার কত্ত সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, টাওয়ারের কিন্তু তার লাগে সিগনাল আদানপ্রদানের জন্য। সেই তারকে বলা হয় অপটিকাল ফাইবার কেবল বা ও এফ সি। কাজেই ও এফ সি-র জাল কতটা ছড়ানো, তার উপর নির্ভর করে আপনার মোবাইল কতটা জোরদার হবে। তাহলে নিশ্চয়ই এই জিও-এয়ারটেল-ভোডাফোন, এই ত্রয়ীর হাতেই গড়ে উঠেছে ভারতের ও এফ সি নেটিওয়ার্ক। অবশ্যই তাই। আসুন দেখা যাক এদের ও এফ সি নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ, অর্থাৎ কত কিমি তার তারা পেতেছে –
রিলায়েন্স জিও – ৩,২৫,০০০
এয়ারটেল – ২,৫০,০০০
ভোদাফোন – ১,৬০,০০০
মোট ৭,৩৫,০০০ কিমি। নিশ্চয়ই ভাবছেন ভাগ্যিস, এরা এসেছিল, তাই আমি যেখানেসেখানে বসে মোবাইলে গুলতানি করতে পারি। সরকারি কোম্পানি পারত নাকি এমন কাণ্ড করতে!
তাহলে জেনে নিন, শুধু বি এস এন এলেরই ও এফ সি নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য হল ৭,৫০,০০০ কিমি। অর্থাৎ তিন প্রাইভেট কোম্পানির মোট নেটওয়ার্কের থেকেও বেশি। এবং সবাই সবার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিন কর্পোরেট কোম্পানি যে পরিমাণে বি এস এন এলের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, বি এস এন এল অন্যদের ব্যবহার করে অনেক কম। আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, তাতে আমার কী? আমি দেখব সার্ভিস কেমন। বি এস এন এলের সার্ভিস বলে যে কিছুই নেই, সেটা তো সব্বাই জানে। তাহলে আসুন, এর পিছনের গল্পটা একবার শুনে নিই।
ভারতে মোবাইল টেলিফোনি প্রথম এনেছিল কমান্ড কোম্পানি। নানান হাত ঘুরতে ঘুরতে এয়ারটেল আর হাচ (বর্তমানের ভোডাফোন) হয়ে ওঠে দুই প্রধান খেলোয়াড়। বি এস এন এল-কে মোবাইল সার্ভিসে নামতে দেওয়া হয় এর পরে। সেই সময়ে ইনকামিং কলেও চার্জ লাগত যা আউট গোইং কলের প্রায় সমান ইছিল। আমি যখন প্রথম মোবাইল নিতে বাধ্য হই (২০০২ সালে) তখন আউট গোইং চার্জ ছিল ১.৯৯ টাকা/মিনিট আর ইন কামিং চার্জ ১.৭৫ টাকা/মিনিট। কারণ তখন ইন্টার-কানেকটিভির জন্য অন্য কোনো কোম্পানির ও এফ সি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলে তার দাম দিতে হত। বোঝাই যাচ্ছে, এই ব্যবস্থার সুফল যেত বি এস এন এলের ঘরেই। কারণ প্রায় পুরো নেট ওয়ার্কটাই ছিল বি এস এন এলের। নিজেদের দুই গ্রাহকের মধ্যে কথা চালাতেও এইসব কোম্পানিকে বি এস এন এলের দ্বারস্থ হতে হত। বি এস এন এল গাঁটের কড়ি খরচ করে সেই পরিকাঠামো বানিয়ে চলল, যার বাণিজ্যিক সুবিধা নিল প্রাইভেট অপারেটররা।
ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে বাতিল হয়ে যাওয়া CDMA প্রযুক্তি নিয়ে ভারতে ব্যবসা শুরু করল রিলায়েন্স। কিছুদিন পরেই TRAI অর্থাৎ টেলিফোন রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া নির্দেশ দিল ইন্টার-কানেকটিভিটির জন্য কোনো দাম নেওয়া চলবে না। এই নির্দেশের ফলে প্রবল ক্ষতির মুখে পড়ল বি এস এন এল। পরিকাঠামোয় যে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছিল, সেটা হয়ে গেল অনুৎপাদক। তার থেকে মুনাফা আদায়ের আর রাস্তা রইল না। অন্যদিকে বি এস এন এলের পরিকাঠামো বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর লাভের বহর গেল বেড়ে। এই পরিস্থিতিতে বি এস এন এল নিজের ক্ষতি সামলাতে পারত একমাত্র মোবাইল ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে।
এই সময় পর্যন্ত ভারতে ছিল টু জি টেলিকম সার্ভিস। তার লাইসেন্স প্রদান নিয়ে পরবর্তীকালে বিশাল কেলেংকারী হয়। ইতিমধ্যে চলে এসেছে থার্ড জেনারেশন বা থ্রি-জি মোবাইল প্রযুক্তি। ২০০৬ সালে কেন্দ্রিয় সরকার সিদ্ধান্ত নিল বি এস এন এল-কে থ্রি-জি স্পেকট্রাম ব্যবহার করতে দেওয়া হবে পরীক্ষামূলকভাবে। অর্থাৎ সেই একই গল্প। পরিকাঠামো গড়ে তোলা এবং দায় বি এস এন এলের। থ্রি জি মোবাইল সার্ভিসের প্রসারের জন্য বি এস এন এল নতুন নতুন গ্রামীন এক্সচেঞ্জ গড়ে তোলে। এরপর সরকার থ্রি জি স্পেক্ট্রাম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। স্বভাবতই বি এস এন এলও যে অন্যতম খরিদ্দার হবে, সেটাই স্বাভাবিক। না, বি এস এন এল-কে নিলামে দর হাঁকার সুযোগ ট্রাই দেওয়া হল না। তার আগেই থ্রি জি স্পেক্ট্রামের একটা অংশ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হল। শর্ত হল, নিলামে প্রতিটি টেলিকম সার্কলে যে সর্বোচ্চ দর উঠবে, বি এস এন এল-কে সেটাই দিতে হবে। আরো শর্ত দেওয়া হল, এক বছরের মধ্যে এক কোটি নতুন ব্রড ব্যান্ড গ্রাহক বানাতে হবে।
বলতেই পারেন, বি এস এন এল-কে তো স্পেক্ট্রাম দেওয়াই হল। তাহলে আর অসুবিধে কোথায়? অসুবিধা এটাই যে লাভজনক সার্কল বেছে শুধু সেখানেই লাইসেন্স নেবার সুযোগ আর থাকল না। অন্য যাবতীয় কোম্পানি কিন্তু সেই সুযোগটা পেল। আবার বাড়তি এক কোটি ব্রড ব্যান্ড গ্রাহকের শর্ত পূরণের জন্য গ্রামীণ এক্সচেঞ্জগুলোকে ঢেলে সাজাতে হল। সরকারের যুক্তি ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বি এস এন এল-এর দায়িত্ব আছে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা পৌঁছে দেবার।
এর পরে পরেই চলে এল ফোর জি সার্ভিস। ২০১৪ সালে ফোর জি স্পেক্ট্রাম নিলাম করা হল। সারা ভারতেই ফোর জি স্পেক্ট্রাম পেল রিলায়েন্স জিও। বিভিন্ন সার্কলে সেই অধিকার পেল এয়ারটেল, ভোডাফোন এবং আইডিয়া। বি এস এন এল-কে সেই নিলামে অংশগ্রহণ করতেই দেওয়া হল না। অনেকেই ভেবেছিলেন থ্রি জি স্পেক্ট্রাম নিলামের মতই পরবর্তীকালে সর্বোচ্চ দামেই বি এস এন এল-কে স্পেক্ট্রাম দেওয়া হবে। না, অদ্যাবধি সেটা হয়নি। ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে নির্বাচনী সংযোগের জন্য সরকার বি এস এন এল-কে ফোর জি স্পেক্ট্রাম দিতে বাধ্য হয়েছিল। বানিজ্যিকভাবে ফোর জি সার্ভিস দেবার অনুমতি বি এস এন এল এখনো পায়নি। কেবল চণ্ডীগড়ে সরকারি দপ্তর ও আধিকারিকদের কেবল দপ্তরসংক্রান্ত যোগাযোগের জন্যই সেই সীমিত অধিকার পেয়েছে। স্বভাবতই বি এস এন এল ক্রমাগত গ্রাহক হারাচ্ছে। যে বিপুল মূলধনী বিনিয়োগ করানো হয়েছিল সরকারি চাপে, তার দায় চেপে বসেছে ঘাড়ের উপর।
প্রাইভেট অপারেটররা যাতে ফাইভ জি সার্ভিসে নিজেদের তুলে আনতে পারে, তার জন্য হাই ফ্রিকোয়েন্সি স্পেক্ট্রাম তাদের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা চলছে। আর বি এস এন এল-কে আটকে রাখা হয়েছে থ্রি জি-র স্তরে। তাই বি এস এন এলের আর্থিক ক্ষতি ছিল অনিবার্য। সেই ক্ষতি বি এস এন এলের অকর্মণ্যতা কিংবা অপদার্থতার জন্য হয়নি। হয়েছে সরকারের কারণে। আজ ৭৪,০০০ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্যের দায় নিতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজি নয়। অথচ ৯০,০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে বি এস এন এল বন্ধ করে দিতে রাজি। অর্থাৎ প্রাইভেট অপারেটরদের প্রতিদ্বন্দ্বী কমানোই যে এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য, সেটা পরিস্কার।
এই ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের পিছনে পরপর চারটি কেন্দ্রিয় সরকারের ভূমিকা কমবেশি একই। কেউ ছুরিটা খুব চালাকি করে চালিয়েছে যাতে আঘাতের চিহ্নটা নজরে না পড়ে। আর কেউ, হয়তো স্পনসরদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি বজায় রাখার দায়ে, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না, কুড়ুল চালাতে শুরু করেছে।


Find out more: