রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন নিয়ে বর্তমান সরকারের কাজকর্মের সঙ্গে পূর্বতন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস সরকারের কাজের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী ড. আবদুস সাত্তার । ‘ সবার পিছে , সবার নীচে সাচার প্রতিবেদন :‘ দুঃখিনী বর্ণমালা ‘শীর্ষক প্রবন্ধটির মূল বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই ‘ বাংলার জনরব‘ নিউজ পোর্টাল ফলাও করে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে । এরপরেই দেখা গেল কলকাতা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম সাত্তার সাহেবের প্রবন্ধটি আলোকপাত করেছে । সেই সঙ্গে তৃণমূল সরকারের দাবির কথা তারা লিখেছে ।তৃণমূল সরকার যাই বলুক বাস্তব কিন্ত আবদুস সাত্তারের মতামতেই উঠে এসেছে । মমতা সরকার যতই দাবি করুক সংখ্যালঘু উন্নয়নে তারা দেশের সেরা, বাস্তবে সংখ্যালঘু উন্নয়নে স্তোকবাক্য ছাড়া আর কিছুই করেনি তৃণমূল সরকার। সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে , বাস্তবমুখী কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি । রাজ্যের সাধারন মানুষের কাছে সংখ্যালঘু উন্নয়ন এই সরকার কেমন করেছে তা যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ পৌছে দেওয়ার লক্ষ্যে ড. আবদুস সাত্তারের লেখা সবার পিছে , সবার নীচে সাচার প্রতিবেদন : দুঃখিনী বর্ণমালা প্রবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে বাংলার জনরব-এ প্রকাশিত হচ্ছে । তবে প্রতিবার শিরোনাম আলাদা থাকবে । মূল লেখাটি কংগ্রেস বার্তার শারদীয়া সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে । শুধুমাত্র শিরোনাম আলাদা হবে । আজ শেষ কিস্তি । প্রকাশিত অংশের পর —
ছয়. রাজ্যে ওয়াকফ কর্পোরেশন গঠন : স্বাধীনোত্তর ভারতে বহুল চর্চিত ও বিতর্কিত বিষয় হল ওয়াকফ সম্পত্তির পুনরুদ্দার , রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন । এই বিষয়ে সাচার কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করেছিল । সেই সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্তরে ওয়াকফ কাউন্সিল ‘ ওয়াকফ উন্নয়ন কর্পোরেশন ‘ গঠন করে কংগ্রেস সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল । ওয়াকফ সম্পত্তির উন্নয়ন করে যাতে সংখ্যালঘু ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , কর্মসংস্থান , বাসস্থানসহ প্রয়োজনীয় কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় । আমাদের রাজ্যে বহু সম্পত্তি আছে , যেখানে উন্নয়নের সুযোগ আছে । কলকাতা শহরে এই ধরনের প্রায় ১৪টি সম্পত্তি চিহ্নিত করে এসেছিলাম যেখানে সম্পত্তির উন্নয়ন করে কর্মসংস্থান , আবাসনের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় । এই সংক্রান্ত যাবতীয় নথি ওয়াকফ বোর্ড-এ সংরক্ষিত আছে । এখন তো সরকারের সব কিছুরই বিরোধিতা করার মত ‘ ধ্বংসাত্মক কোনও বিরোধী দল ‘ নেই । তাই চাইলে এই সরকার সকলের সহযোগিতায় এই কাজগুলো করতেই পারেন ! কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই শুভ মানসিকতার প্রতিফলন কোথায় ? আশা করব , অবিলম্বে রাজ্যে ওয়াকফ কর্পোরেশন গঠিত হবে ।
সাত . রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা , দাঙ্গা রোধ ও প্রশমনে আইন প্রণয়ন : ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ , প্রতিদ্বন্দ্বিতা , সংঘর্ষ , এমন-কী দীর্ঘকাল পাশাপাশি বসবাসের পরেও ভারতের দুই মুখ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মাতাত্ত্বিক বিচারে শ্রেষ্ঠত্ব অথবা একে অপরের হাতে উৎপীড়ন ও লাঞ্ছনার নানা ধরনের প্রকৃত ও কল্পনার স্মৃতি থাকা সত্ত্বে ইহজাগতিক প্রয়োজনে বিষয়গুলি বড় হয়ে ওঠেনি । বলা ভালো তা ছিল কার্পেটের তলায় । কিন্তু নব্বই-এর দশকের ঘটনাবলী , বিশেষত অযোধ্যা আন্দোলন দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে অতীতের সমস্ত কিছুকে মুছে ফেলে বৈরিতা আর শত্রুতার বেশে ভারতের সমাজ রাজনীতিতে হাজির হলো । রাজনীতির এই বিনির্মাণে গরিব সংখ্যালঘুরাই হলেন সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ । আর কে না জানে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রোষে সব থেকে বিপন্ন হয় গণতন্ত্র , ধর্মনিরপেক্ষতা , আইনের শাসনের মতো ভারতীয় সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলি । উপরিউক্ত এই প্রেক্ষিত , ভাবনা থেকেই কংগ্রেস সরকার ২০০৫ সালে রাজ্যসভায় পেশ করেছিল ` The Communal Violence ( Prevention , Control and Rehabiliation of Victims ) Bill 2005 ‘ । আরএসএস-বিজেপি-এর প্রবল বিরোধিতায় তা পাশ হয়নি । আবারও ২০১৩ সালে কংগ্রেস সরকার বিলটির পরিমার্জন করে ‘ The prevention of Communal Violence ( Access to Justice and Reparations ) Bill 2013 ` পেশ করে কিন্ত একই অবস্থা হল । এখন প্রশ্ন হল , ‘ রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদী দেশভক্ত’দের অস্থির পদচারণা পশ্চিমবঙ্গের মতো আপাত শান্তির মরুদ্যানকেও কলুষিত করতে চাইছে । রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষামন্ত্রী কী উপরিউক্ত বিলটি রাজ্যের বিধানসভায় উত্থাপন ও পাস করানোর কথা ভাবতে পারেন না ?
সাচার কমিটি ও কুন্ডু কমিশনের সুপারিশগুলির বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন উন্নয়নের প্রশ্নে সকলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হবে , অন্যদিকে তেমনিভাবে সমসুযোগের বিষয়টিকে জনমানসে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়ে উঠবে । ফলত , নির্মিত হবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয়-সামাজিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সমতার বাতাবরণ । তাই এর জন্য চাই যথার্থ রাজনৈতিক সদিচ্ছা ।
২০১১ সাল থেকে এই কাজগুলিই তো তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের করার কথা ছিল । কিন্ত কোথায় সেই উদ্যোগ ? কোথায় সংখ্যালঘু উন্নয়নে সেই প্রয়াস ? বাস্তবে ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের ভাতা ছাড়া সবই তো পূর্বতন কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকেই এই সরকার এগিয়ে নিয়ে চলেছে । আবার এও শোনা যাচ্ছে যে , কোনও কোনও প্রকল্প নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ! মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার সব থেকে বড় উদাহরণ । অনুমোদিত ৪০৫ টি মাদ্রাস শিক্ষাকেন্দ্র ও ২০০টি নিউ সেট আপ মাদ্রাসা আজও অনুমোদন পেল না । মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন বন্ধ করার নিমিত্তে নিত্য নতুন খেলা চলছে । মাদ্রাসাগুলিতে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক পদ শূন্য । প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা –শিক্ষাকর্মীর অভাব । পঠন-পাঠন ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত ! শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলীর বিষয়টি বাক্সবন্দী । সব মিলিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় এক চূড়ান্ত নৈরাজ্য চলছে । অথচ সরকার এই বিষয়ে নীরব , নিশ্চল , নিশ্চুপ ! নতুন তো আর কিছু হল না । যা ছিল তাও সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না । শুধু তাই নয় , অর্থবিহীন ১০ হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন-বাণীর হুঙ্কারও আর শোনা যাচ্ছে না ! কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে অনুমোদিত ২৩৮ টি মাদ্রাসারও সমস্যার শেষ নেই ! কেন্দ্রীয় সাহায্যও অপ্রতুল ! এই উপমহাদেশের গর্বের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় আজ কী হাল , তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন।
কেন্দ্রে কংগ্রেস ও রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সাচার কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ ও তার রূপায়ণের বিবরণ সেই সময়কার সরকারি দলিলে স্পষ্টরূপে মুদ্রিত আছে । চাইলেই সচেতন ব্যক্তি , গোষ্ঠীমাত্রেই জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করতে পারেন । এই বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা-বির্তকের মধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত হবে অতীত আর বর্তমানের প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু উন্নয়নের রেখচিত্র ! যে রেখচিত্রে অনাগত ভবিষত্যের দিক চিহ্নময় পদচিহ্নের ধ্বনিতে শোনা যাবে । ধরা পড়বে ফাঁক ও ফাঁকি । রক্ষিত হবে মানুষ হিসাবে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার । প্রাণ-প্রতিষ্ঠা পাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি । হয়তো এই পথেই নির্মিত হবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জয়গান ।