দেশজুড়ে বিজেপি–আরএসএসের তথাকথিত দেশভক্তদের উল্লাসে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরা দিশেহারা । তবে আশার আলো হিসাবে দেখা দিয়েছে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভার ফলাফল । সাধারন মানুষ যে আরএসএস –বিজেপির কথিত দেশভক্তির চেয়ে রুটি–রুজির দিকে বেশি নজর দিতে চাইছে তার সংকেত হল এই নির্বাচনের ফলাফল । কিন্ত তা সত্ত্বে বলা যাবে না গেরুয়াপন্থীদের দাপট কমে গেছে , বরং বলা যেতে পারে তারা হোঁচট খেয়েছে মাত্র । তাদের আদর্শ ও নীতি এখনও জারি রয়েছে । কীভাবে এল হিন্দুত্বের শ্লোগান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে আরএসএসের দাপট ? এর নেপথ্যে কোন কোন রাজনৈতিক দল গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপিকে মদত দিয়েছে । আরএসএস–বিজেপির শিকড় কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে প্রবেশ করল তা নিয়ে কলম ধরেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদক ড. আবদুস সাত্তার । বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে । আজ  সপ্তম কিস্তি । প্রকাশিত অংশের পর …
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক কূট-কৌশলে শাসন ও শোষণের লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে সক্ষম হয়েছিল । এ এক ঐতিহাসিক সত্য । ইংরেজ উপনিবেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় , দেশভাগ , ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে । স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে ভারত সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতাকে অঙ্গীকার করে ৭২ বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করেছে । কিন্ত যন্ত্রণার হলেও সত্য যে , ঔপনিবেশিক শাসকদের ছেড়ে যাওয়া ইতিহাসের সেই সুপরিচিত বিভাজন করো । শাসন করো স্বাধীন ভারতে বিরামহীনভাবে পুনরাবৃত্ত হয়ে চলেছে । অতীত ইতিহাসের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে । ছলে-বলে কৌশলে , আদর্শহীন আপোষ – সমঝোতার  রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে কী এক কঠিন আকার ধারণ করেছে ? দেশপ্রেমের ছদ্মবেশে সাংস্কৃতিক উগ্র জাতীয়তাবাদের শেকড় নাভিমূলে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে । শাসক আসে , শাসক যায় কিন্ত মনুষ্যত্ব হরণকারী এই খেলার কোনো বিনাশ হয় না । পরিণতি ‘ মানুষের হাতে মানুষ হতেছে নাজেহাল ‘। আবার , কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিভাজনের একই মতাদর্শের  সরকার থাকলে দাঙ্গার প্রকোপ ও ভয়াবহতা বহুগুণে বেড়ে যায় । গুজরাটের গোধরা তার এক অমানবিক , নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত । পরিণতিতে আক্রান্ত হচ্ছে সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার , সমানাধিকার , মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার ন্যুনতম মৌলিক অধিকার । ন্যায়ের পথ আগ্রাসী বিভাজনকারী শক্তির ক্ষমতার আস্ফালনে দিনের পর দিন মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত সংকটাপন্ন হচ্ছে। অসহায়তা , কান্নাও শেষ পর্যন্ত নীরবতার কোলে বাধ্যতামূলক অবলম্বন হয়ে আশ্রয় নেয় । ক্ষমতা যুদ্ধে শালীনতার লেশটুকু মাত্র আর থাকছে না ।
ন্যায়ের পথে ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন জওহরলাল নেহেরু দেখেছিলেন আজ তার নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছে । ‘দাঙ্গার ক্ষত , ‘দগ্ধ হৃদয় ‘ নিয়ে দেশের  ১৮ কোটি সংখ্যালঘু মানুষ অস্তিত্বের প্রশ্নে আজো অসহায় , ন্যায় বিচারের আশ্রয় প্রার্থী । এমন কী বহু রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের একদেশদর্শী মনোভাবের কারণে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা ঠিক মতো এফআইআর-ও করতে পারেন না । এফআইআর-এর সেই ছিদ্রপথেই বিচারের বাণী পথ খুঁজে পায় না । রাষ্ট্রীয় কল্যাণে, নির্দেশনায় এফআইআর-এ নাম না থাকলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তরা নাকি ক্ষতিপূরণ পাবে না ! দরিদ্র , নিপীড়িত , লাঞ্ছিত , শোষিত মানুষের জন্য শাসকের কান্না আর ভিজে স্নিগ্ধ হয় না । সব ‘ রা ‘ উবে গেছে । রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কমিটি –কমিশন , প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় । ধূলোর আস্তরণ জমতে থাকে । কিন্ত মনুষ্যবিদারী এই শক্তির কোনো বিরাম নেই , শতাব্দী প্রাচীন বিষয়গুলিকে দেশপ্রেমের মোড়কে সাংস্কৃতিক উগ্র জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে নিত্য-নতুন পথে , নিত্য নতুনভাবে যোগিত্বের বেশে জনমানসের কাছে হাজির করা হচ্ছে । পরিকল্পিতভাবে এমন একটি বাতাবরণ ,পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে যেখানে স্বতন্ত্র অঞ্চল , ধর্মীয় ও জীবন যাপনের পার্থক্যগুলিতে আগ্রাসী, বিদ্বেষী রাজনীতির অঙ্গে রূপান্তরণের এক ভয়ঙ্কর তিমির বিনাশী প্রমত্তলীলা চলছে । জাতীয়তাবাদের এই নবনির্মাণে সাম্প্রদায়িকতার পথ প্রশস্ত হয়ে ভুবনবিদারী হয়ে উঠেছে ।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারত অন্বেষণের অগ্রপথিক ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ‘ ভারতমাতা’র ভাবমূর্তির সঙ্গে জাতীয়তাবাদীদের আবেগ-সংশ্লেষ নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন তা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে নতুন নতুন সংজ্ঞাদানের বিষয়টি বুঝতে আজও আমাদের সাহায্য করতে পারে । অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি ‘ জাতীয়তাবাদ , সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তির প্রশ্নে ‘ শীর্ষক গ্রন্থে বিষয়টি সম্পর্কে লিখেছেন ,‘ তাঁর কাছে মনে হয়েছে এই মূর্তিটি ( ভারতমাতার মূর্তি ) হচ্ছে সুন্দরী এক মহিলার । যিনি অতি প্রাচীন কিন্ত চেহারায় সব সময়ই নবীন । চোখ দুটি তাঁর বিষন্ন ও নিঃসঙ্গ , বিদেশী ও বহিরাগতদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে পীড়িত হয়েছেন ,নিজ সন্তানদেরকে তিনি ডাকছেন তাঁকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য । এই ধরনের একটা ভাবমূর্তি হাজার হাজার ভারতবাসীকে আবেগে আকূল এবং সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছে । নেহেরুর মনে প্রশ্ন জেগেছে , এই মূর্তিটি কী স্বয়ং সম্পূর্ণ ? কেন না চোখের সামনে কৃষক ও শ্রমিকদের যে ভারতকে তিনি দেখতে পেয়েছেন তা মোটেই সুন্দর নয় : দারিদ্রের কোনো সৌন্দর্য নেই , তাঁর মনে জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছে ‘ কল্পনার ওই সুন্দরী মহিলা কি মাঠের কারখানার বস্ত্রহীন ন্যূব্জ মেহনতিদের প্রতিনিধি  ?’….. তাঁর মনে হয়েছে যে , শিক্ষিত মানুষেরা যা করেছে তা হল একটি কাল্পনিক মূর্তি দিয়ে সত্যকে ঢেকে ফেলা, বাস্তব জগত থেকে পালিয়ে স্বপ্নের জগতে আশ্রয় নেওয়া ।

Find out more: