এনআরসি ও সিএএ নিয়ে দেশ জুড়ে যখন তীব্র বিরোধিতা চলছে তার মধ্যেই জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর) পরিমার্জন খাতে ৩৯৪১ কোটি বরাদ্দ করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে ২০২১ সালের আদমশুমারির জন্য বরাদ্দ হল ৮৭৫৪ কোটি টাকা।
বিরোধীদের অভিযোগ, এ ভাবেই ঘুরিয়ে এনআরসি তৈরির কাজ শুরু করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি, ‘‘এনপিআরের সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই।’’ এনপিআরের কাজ শুরু হবে ২০২০ সালের এপ্রিলে, চলবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এনপিআরে তথ্য দেওয়া ঐচ্ছিক এবং তা প্রমাণের জন্য কোনও নথি দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
সিএএ ও এনআরসি প্রসঙ্গে দেশ জুড়ে নাগরিক প্রতিবাদে কোণঠাসা শাসক শিবির। তারই মধ্যে এনপিআর সংক্রান্ত ঘোষণায় নতুন করে যাতে গন্ডগোল না-ছড়ায় সেই জন্য বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেন শাহ। ইতিমধ্যেই এনপিআরের কাজ স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল। শাহ আজ দাবি করেন, ‘‘এনআরসির সঙ্গে এনপিআরের কোনও সম্পর্ক নেই। এনপিআরে কেউ বাদ গেলেও তাঁর নাগরিকত্ব যাবে না।’’
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজের বক্তব্য ঘিরেই আজ ধোঁয়াশা ছড়িয়েছে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এনআরসি-তে ১৯ লক্ষ নাম বাদ পড়া অসম। শাহ বলেন, ‘‘অসমে এনআরসি হয়ে গিয়েছে বলে সেখানে এনপিআর হবে না।’’ প্রশ্ন হল, এনপিআর এবং এনআরসি যদি আলাদা হয়, তা হলে অসমে এনআরপি হবে না কোন যুক্তিতে? এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে জবাব মেলেনি।
এ দিকে, রেজিস্টার জেনারেল অ্যান্ড সেন্সাস কমিশনার, ইন্ডিয়ার একটি বার্ষিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, এনপিআর হল এনআরসির প্রথম ধাপ। ২০১৪ সালের ১৮ জুন পিআইবির টুইটে বলা হয়েছিল, এনপিআর থেকে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন রাজনাথ সিংহ। তিনি তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সেই বছরই ২৬ নভেম্বর রাজ্যসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজুও বলেছিলেন, ‘‘এনপিআরের পরেই এনআরসি হবে। দেশবাসীর নাগরিকত্ব যাচাই করে দেখা হবে।’’ এই সব উদাহরণ তুলে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘বিজেপি যে ধোঁকা দিচ্ছে, তা এর থেকেই স্পষ্ট।’’
এই পরিস্থিতিতে এক-এক মন্ত্রীর এক-এক রকম মন্তব্যের দায় কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের উপরেই চাপিয়েছে বিজেপি। তাদের মতে, আধিকারিকদের পাঠানো নোটের ভিত্তিতেই মন্ত্রীরা যা বলার বলেছেন।
ধোঁয়াশা রয়েছে এনপিআরে আধার সংক্রান্ত তথ্য নিয়েও। কেন্দ্রীয় প্রকাশ জাভড়েকর জানান, কেউ না-চাইলে এনপিআরে আধার সংক্রান্ত তথ্য না-ও দিতে পারেন। সেখানে শাহের বক্তব্য, ‘‘আধার নম্বর থাকলে কেন কেউ তা দেবে না।’’
তা ছাড়া, জনগণনার সময়েই তো গণনাকর্মী প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। তা হলে আলাদা করে এনপিআর করার প্রয়োজন কোথায়? এই প্রশ্নে শাহ আজ শুধু বলেন, ‘‘দু’টি আলাদা আইন।’’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উত্তর, জনগণনার তথ্য আধারের মতোই গোপনীয়। তা ছাড়া, জনগণনার ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে একটি পরিবারের তথ্য নেওয়া হয়। কিন্তু এনপিআরে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়। এনপিআরের তথ্যের ভিত্তিতে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বুঝে জনমুখী পরিকল্পনা তৈরি হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র জানিয়েছে, ২০১১ সালের এনপিআরে ১৫টি প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ বারে প্রশ্ন বাড়তে চলেছে। এ দফায় বাবা-মায়ের জন্মস্থান, জন্মতারিখ জানতে চাওয়া হবে। জাভড়েকর অবশ্য বলেন, ‘‘সেই তথ্য দেওয়া ঐচ্ছিক।’’ কিন্তু বাবা-মায়ের জন্মস্থান না-বললে বা আধার নম্বর না-জানালে সংশ্লিষ্ট নাগরিক সন্দেহের তালিকায় পড়বেন বলে বিরোধীদের আশঙ্কা। অসমে এমনটাই হয়েছিল। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, এনপিআরে কোনও সন্দেহজনক নাগরিকের তালিকা তৈরি হবে না। মন্ত্রক দাবি করলেও, বিজেপি যে-ভাবে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার প্রশ্নে সরব, তাতে এনপিআরের তথ্য সংগ্রহ থেকেই এনআরসির কাজ শুরু হবে বলে আশঙ্কা বিরোধীদের।