[11:35 PM, 1/5/2020] Bhootnath Paramanik: স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলিতেই সূচনা হয়েছিল আজকের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পরম্পরা । সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ধর্ম ও রাজনীতির বৃহত্তর পথে সমন্বিত হয়ে জাতির জীবনে হাজির হয়েছিল । তারই বহিঃপ্রকাশ – কখনো বা স্বদেশী আন্দোলন অথবা মারাঠা কুলপতি ছত্রপতি শিবাজি, প্রত্যাপাদিত্যকে সংগ্রামের নায়ক, প্রতীক , আইকন হিসাবে জনমানসে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে এক অনন্য ধারার সূচনা হয় । রাজনীতির ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে হিন্দু আইকন , হিন্দু ক্রিয়াকলাপ , ধর্মানুষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে থাকে । মিথ , প্রতীকের আবেগময় ব্যবহারে তা আরো ব্যঞ্জনাপূর্ণ ও আকর্ষণীয়ভাবে মানুষের কাছে হাজির করা হতে থাকে । যেমন , বাল গঙ্গাধর তিলক-এর ব্যবস্থপনায় ‘গণেশ উৎসব’-এর নব প্রবর্তনা। রাজনীতির এই নব ধর্মীয় নির্মাণে মুসলিম , দলিত , আদিবাসীরা নিজেদের একাত্ম করতে পারেনি । ‘ ভদ্রলোকের রাজনীতি’র এই বিচ্ছিন্নতা ইতিহাসের এক অমোঘ উপাদান । আবার সম্পদের আভিজাত্য সংস্কৃতি’র আভিজাত্যে রূপান্তরিত হতে থাকে ।
‘হিন্দুরাষ্ট্র’ নির্মাণকল্পে আজকের যে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রসার তার সূচনা অবশ্যই বিশ শতকের প্রথম পর্বের ঘটনা । এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে , ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন , ১৯০৯ সালের মার্লে মিন্টো সংস্কার হয়ে ১৯৩২ –এ স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী,সংরক্ষণের মতো বিষয় গুলি এই শক্তিকে সংহত করতে সাহায্য করেছে । তাই এই অসহনীয় অবস্থা একদিনে নয় , ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ তা ধারণ করেছে এক কঠোর , কঠিন সাংগঠনিক আকার ।কংগ্রেস নেতা পন্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠিত ‘ হিন্দু সভা’র হাত ধরেই ‘ হিন্দুত্বের তত্ত্ব ‘ ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে , স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে আপন বৈধতা খুঁজে পেতে সমর্থ হয় । মৃত্যুর বহুকাল পরে মোদী সরকারের ‘ মরণোত্তর ভারতরত্ন’ সম্মানে বিভূষণ কি তারই স্বীকৃতি নয় ?
পরবর্তীতে যা বহুভাবে, বহুরূপে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে । চকিত বিস্মিত করেছে । এই ভাবনা-ভাষ্যেরই সাংগঠনিক –সংস্কৃতিক –রাজনৈতিক রূপ কখনো তা রাম রাজ্য পরিষদ , হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ. জনসঙ্ঘ কিংবা পদ্মশোভিত আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি ।মনে রাখতে হবে ,রামরাজ্য পরিষদ , জনসঙ্ঘ কিংবা বিজেপি’র মতো দলগুলির রাজনৈতিক –সাংস্কৃতিক –সাংগঠনিক ভিত্তি নির্মাণ, তাত্বিক নেতা সরবরাহের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে চলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। কখনো সোচ্চারে , কখনো নীরবে , নিঃশব্দে । অবশ্য , আজ আর আগলটুকুও নেই ।সরকারে আসীন ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই এখন গর্বভাবে নিজেকে সেবক , প্রধান সেবক বলে চিহ্নিত করতে ভালোবাসেন ।তাইতো কেন্দ্রীয় ও রাজ্যে বিজেপি সরকার , প্রশাসনের চালিকাশক্তি ,প্রাণভোমরা তো রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ( আরএসএস)। যদিও অনেকে দাবি করে থাকেন বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্ম্পূণত বিষয়টি প্রযোজ্য নয় । কিন্ত এও তো সত্য , প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন জনসঙ্ঘের প্রাক্তন সভাপতি । তাই কি ২০০২ সালে গোধরা নরসংহারের সময়ে বাজপেয়ী কথিত ‘ রাজধর্ম’ পালনের কি অর্থ হয়ে ওঠে ? রাজত্ব করো , ধর্ম পালন করো ?১৯২৫ সালে মহারাষ্ট্র নিবাসী কেশব হেডগেয়ার ‘ হিন্দুত্বের তত্ত্ব’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের লক্ষ্যে নির্মাণ করেন এক জাতীয় প্রতিষ্ঠান যা আজ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ হিসাবে পরিচিত । জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি ও ইতালিতে মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী শক্তির আদলে সঙ্ঘের সামরিক রূপদানে তিনি তৎপর ছিলেন । পরবর্তীকালে সঙ্ঘের সংগঠক ও প্রচারকগণ হেডগেয়ারকে সংবিধানের অন্যতম স্থপতি , উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক ড. বি আর আম্বেদকরের সঙ্গে ‘ দুই ডাক্তার ‘হিসাবে সামাজিক বৈধতা প্রদানের কাজে ব্রতী হন । অথচ কে না জানেন , আম্বেদকর ছিলেন বিশ্বের অগ্রগণ্য দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাধিপ্রাপ্ত ডক্টরেট । এই তুলনায় যে ,বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তা হলো সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতাকে বর্ণাশ্রম প্রথার অসহায় নিপীড়নের শিকার দলিত সমাজের মানুষের কাছে সহনীয় করে তোলার জন্য কি ছলনাময় প্রকাশ ?
স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে , ঝন্ঝা-ক্ষুদ্ধ সময়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য , সম্মিলনের ভাবনায় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী সব সময়ই এক অনন্য উদ্ভাবনী শক্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন । অসহযোগের সঙ্গে খিলাফতের মতো বিষয়কে সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে এই উদ্ভাবনের যাত্রাপথের সূচনা হয় । আবার , এই প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক সংযুক্তিরও সূচনা হলো । অনেকের সঙ্গে রাজনীতির দ্বিতীয় পর্বে ‘ দ্বি-জাতি তত্ত্বে-’র প্রবক্তা মহম্মদ আলি জিন্নাহ এই সংযুক্তিকরণকে মেনে নিতে পারেননি । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , ১৯২৩ সালে ‘ বীর’ সাভারকর তাঁর ‘ হিন্দুত্ব’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষয়টি প্রথম ভারতীয় সমাজমানসে তুলে ধরেন । জিন্নাহ’র আপত্তি সত্ত্বেও গান্ধীজি ইতিহাস-খ্যাত আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম করে অগ্রসর হলেন । স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে , একদিকে ক্ষীয়মান খলিফার নেতৃত্ব নাকি ধর্মনিরপেক্ষ , আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা – কোনটিা তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বলাভে সমর্থ হয়েছিল ? একথা ঠিক যে , এই আন্দোলনের সংযুক্তিকরণের ফলে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে –প্রাণে –হৃদয়তন্ত্রীতে তুরস্কের প্রতি সংহতির বার্তা ধ্বনিত হলেও কামাল পাশা’র নেতৃত্বে তুরস্কের মানুষের জনজোয়ার, সামন্ততান্ত্রিক রাজার অবসানের কথা কি তাঁর বোধগম্য হয়নি ? নাকি হিন্দুধর্মের সনাতনী ঐতিহ্য , বিশ্বাস ও প্রথায় প্রত্যায়ী মহাত্মাজি’র মনে হয়েছিল ইসলাম ধর্মেও একই ধরনের ভাবনা , বিশ্বাস বিরাজমান ? না –হলে এই ধরনের একটা আবছা ধর্মীয় বিষয়কে অসহযোগের সঙ্গে যুক্ত করলেন কেন ? গান্ধীজী প্রদর্শিত সেই ট্রাডিশন কি আজো সমানে ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হচ্ছে না ? স্বাধীনতা –পরবর্তীকালে নেহেরু –রাজের শেষদিকে এবং অবশ্যই তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী দিনগুলিতে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির ঝুঁকিপূর্ণ , সন্দেহপ্রবণ বোঝাপড়া আজ মহীরূহ হয়ে ভারতীয় সমাজ-মানসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।