স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান হওয়ার পর, অনেক দেরিতে চৈতন্য হয়েছে দিলীপ ঘোষের৷ আজ 'সর্বহারা' হয়ে তিনি বলছেন, "বিজেপি সেই লোকদের উপর নির্ভর করে, যারা রক্ত দিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে দলকে দাঁড় করিয়েছেন৷"  বলছেন, "দল ছাড়াটা এখন অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে"৷ অথচ ইনিই ভোটের আগে রীতিমতো 'যোগদান মেলা' বসিয়ে একের পর এক অন্য দলের লোকজনের হাতে ঘটা করে পদ্ম-পতাকা তুলে দিয়ে গর্বিতসুরে বলতেন, "তুলে দিলাম তৃণমূল কংগ্রেসকে৷ ভোটের পর বাকিরাও চলে আসবে৷ আমরা দরজা বড় করেছি৷"

ভোটের ফল দিলীপবাবুদের স্বপ্নজগত থেকে তুলে এনে আছাড় মেরেছে বাস্তবের কঠোরভূমে৷ বাংলার শাসনক্ষমতা দখলের ত্রিসীমানায় নেই বিজেপি৷ ওদিকে দলের অন্দরে ঘটা করেই বসেছে 'উল্টোরথ'- এর আসর৷ সেদিন যাদের 'সম্পদ' বলে দিলীপ ঘোষরা দলে এনেছিলেন, আজ তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দল ছাড়তে চান৷ উল্টোরথ এগিয়ে চলেছে৷ দু'পাশে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মানুষ, রথে ওঠার অপেক্ষায়৷ এই আবহে দিলীপ ঘোষের বিলম্বিত বোধোদয়, "দল ছাড়াটা এখন অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে"৷ বঙ্গ- বিজেপি আজ ঠাণ্ডা মাথায় ভুলে যেতে চাইছে এই দলবদলুদের পিছনে হাওয়া ভরে অজস্র বিড়ালকে বাঘ বানিয়েছেন তো তাঁরাই৷ আজ সে কথা ভুললে তো চলবে না৷ বিজেপির নেতারাই তো অন্য দলের লোকজনকে নিয়ে দলবদলের এই অভ্যাস গড়ে তুলতে এক একজন 'শিক্ষাগুরু'-র দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ তখন  'তৃণমূল তুলে দিলাম'  ধরে নিয়ে এক বিজাতীয় আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন৷ আজ অন্য সুর কেন ? অন্য দল থেকে কে কতজনকে ভাগিয়ে আনতে পারেন, তার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন বঙ্গ- বিজেপির ৫-৭ জন তথাকথিত শীর্ষনেতা৷ সেই কাজে দলের বোধহীন নেতা-কর্মীদের একাংশের বিস্তর হাততালিও পেয়েছিলেন এনারা৷ তখন দলের যে অংশটি এই ধরনের কাজের বিরোধিতা করেছিলেন, আরও সতর্ক হতে বলেছিলেন, দিল্লির নেতাদের অনুরোধ করেছিলেন, এভাবে অন্য দলের লোকজনকে দলে এনে তাঁদের 'রাজার পার্ট' দেবেন না, সেই অংশটিকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয় বর্তমান নেতৃত্ব৷ প্রকাশ্যে এদের বিরুদ্ধে মন্তব্যও করা হয়৷এই অপমানে আদি- বিজেপির বড় একটা অংশ নির্বাচনে কুটোটিও নাড়েননি৷

ভোটের আগে রাজ্য বিজেপি নেতাদের বোধহীন তৎপরতায় দলের নিষ্ঠাবান কর্মী-সমর্থকরা অনেকেই বসে গিয়েছিলেন বলেই খবর৷ এর ফলে দলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা ফলপ্রকাশের পর স্পষ্ট হয়েছে৷ আর ফলপ্রকাশের পর দলের আরও ক্ষতি করে দলবদলুরাই 'ঘরে' ফিরতে ব্যস্ত হয়ে, দলের আরও একদফা ক্ষতি করতে চলেছেন৷ আর এই দুই ক্ষতির জন্যই দায়ি, রাজ্য বিজেপির শীর্ষ পদাধিকারীরা৷ এদের বিচার কে করবে ? বিজেপি ত্যাগের লকগেট খুলে গিয়েছে৷ ওই লকগেট ব্যবহার করে যে হারে জল এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তাতে আশঙ্কা করাই যায়, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় বঙ্গ-বিজেপি না ফের ১০ বছর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়!

আজ মুকুল, রাজীব, সব্যসাচীদের নিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতারা যত শব্দ খরচ করছেন, তার সিকি ভাগ বুদ্ধিও যদি অন্যদলের লোকজনদের হাতে পাইকারি হারে পদ্ম-পতাকা তুলে দেওয়ার আগে খরচ করতেন, তাহলে আজ দিলীপবাবুদের এভাবে বলতে হতো না, "দল ছাড়াটা এখন অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে"৷ আজ হোক বা কাল, লোকসভা ভোটের অনেক আগেই দিলীপ ঘোষকে সরতে হতেই পারে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে৷ ফের দলবদলের ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর, যারা হাতে থাকবেন, তাঁদের মধ্যেই কেউ সভাপতি বা অন্যান্য পদাধিকারী হবেন৷ ধরে নেওয়া হবে এরাই বিশ্বস্ত৷ আদি নেতাদের নিষ্ঠার সঙ্গে ঘরে তুলে দেওয়ার পর বঙ্গ-বিজেপির ভবিষ্যৎ যাদের হাতে থাকবে, তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা কতখানি, তা এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে৷ কিছুদিন আগেই তো দলের নতুন কমিটি হলো, শাখা সংগঠনের মাথায় আনা হলো নতুন নতুন মুখ৷ তাঁরা এখন কোথায়? দক্ষ দেবজিৎ সরকারকে সরিয়ে যুব মোর্চার সভাপতি করা হয়েছে সাংসদ সৌমিত্র খাঁকে৷

আজ পর্যন্ত দলের যুব মোর্চার সংগঠন শক্তিশালী করতে কোন ভূমিকা পালন করছেন নতুন সভাপতি ? জেলা কমিটি গড়তেই তো তিনবার দিলীপ ঘোষের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছিলেন৷  উনি ব্যস্ত আন্তর্জাতিক, জাতীয়, রাজ্য রাজনীতি নিয়ে৷ গেরুয়া নেতা- কর্মীরা ভুলেই গিয়েছেন  সৌমিত্র খাঁ নামক ভদ্রলোকটি এ রাজ্যের যুব মোর্চার সভাপতিও বটে৷ মহিলা মোর্চার সভানেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল, এসসি মোর্চার সভাপতি দুলাল বর, এসটি মোর্চার সভাপতি খগেন মুর্মূ, কিষান মোর্চার সভাপতি মহাদেব সরকার এখনও পর্যন্ত নিজ নিজ ক্ষেত্রে কোন কাজটা করেছেন, যাতে দলের উপকার হয়েছে? এই ব্যর্থতার দায় তো রাজ্যের সভাপতির ঘাড়েই বর্তায়৷ হয় এই সব পদাধিকারীরা অদক্ষ, লবিবাজি করতেই এদের পদে আনা হয়েছে অথবা এদের কাজ করতেই দেওয়া হয়নি৷ এমন লোকজনই হয় রাজ্য বিজেপির নতুন রাজ্য কমিটিতে আসবেন, অথবা সেই সব লোকজনকেই ফিরিয়ে আনা হবে, যাদের হাতে দল থাকার সময়, এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি বঙ্গ-বিজেপি৷ আরও আছেন, বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় আসছে ধরে নিয়েই দিল্লি থেকে ভোটে লড়তে পাঠানো হয়েছিলো টুইট-নির্ভর নেতা স্বপন দাশগুপ্ত, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়দের৷ ভোটে হারার পর ফিরে গিয়েছেন সেই দিল্লিতেই৷

আপাতত টুইট করা ছাড়া এদের শেষ কবে নিজেদের কেন্দ্রের কর্মীদের পাশে দেখা গিয়েছে, তা বড় জ্যোতিষীও বলতে পারবেন না৷ অনেকে বলবেন, 'এনারা প্রচণ্ড শিক্ষিত, এমন মুখ সামনে থাকা দরকার'৷ কিন্তু এই মুহুর্তে দল বাঁচাতে, কর্মী-সমর্থকদের মনোবল বাড়াতে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে এনারা কতখানি কার্যকর? সাংগঠনিক কাজে এনারা কতখানি দক্ষ? এনারা থাক নৈবেদ্য'র উপর কলার হিসাবে, রাজ্য রাজনীতিতে এনারা একদমই অপ্রাসঙ্গিক৷ দলবদলু অংশের সমালোচনা নিশ্চয়ই করবেন, কিন্তু সেই সমালোচনার আগে বঙ্গ-বিজেপি একবার অন্তত মনে মনে হলেও আত্মসমালোচনা করুক, কেন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সেদিন অন্য দলের 'সম্পদদের' বিজেপিতে সামিল করা হয়েছিল, তাতে দল এগোলো, না পিছিয়ে গেলো ? আর শুধুই দলবদলু বা সম্ভাব্য দলবদলুদের উদ্দ্যেশে বার্তা দিলেই হবে না, দলের সেই সব অংশকে নিয়েও বঙ্গ- বিজেপির  সভাপতিকে ভাবতে হবে যাদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ পদ তুলে দিয়েছিলেন, যাদের ভিন রাজ্য থেকে এনে বাংলায় প্রার্থী করেছিলেন, তাঁরা এখন কতখানি দলের উপকারে  লাগছেন, হতাশ কর্মী-সমর্থকদের পাশে তাঁদের কতখানি আজ দেখা যাচ্ছে, এদের হাতে দল কতখানি নিরাপদ, এসবও তো ভাবতে হবে৷ এ সব ভাবাও রাজ্য সভাপতির দায়িত্বের মধ্যেই তো পড়ছে৷

Find out more: